/ফ্রান্স ছবির দেশ কবিতার দেশ..

ফ্রান্স ছবির দেশ কবিতার দেশ..

ফ্রান্স দেশটি ভ্রমণপিয়াসুদের জন্য স্বর্গ। প্যারিসের মূল এভিনিউ থেকে কোত্ দা জ্যুরের সমুদ্রতীরবর্তী কেতাদুরস্ত রিসোর্ট যেন হাতছানিতে ডাকছে। এই অ লে ছড়ানো বিশ্বের অপরূপ সুন্দর নৈসর্গিক দৃশ্য। ফ্রান্সের রূপকথার দুর্গ, সুউচ্চ গির্জা আর ছবির মতো নিখুঁত গ্রাম রোমান্টিকদের পুলকিত করে। এমনকি প্রগতিশীল ও সমসাময়িক শৈলীতে বাস্তববাদীরাও এখনও বিমুগ্ধ হন। ফ্রান্সের আধুনিকতার প্রতীক আইফেল টাওয়ার। সেজন্য সেখানেই শুরু হওয়া উচিত ফ্রান্স দর্শন। এরপর ল্যুভর জাদুঘরে বিখ্যাত শিল্পকর্মের ভুবনে হারিয়ে যান। ফরাসি রাজপরিবারের উত্তরাধিকারী হওয়ার স্বপ্ন পূরণ করতে একদিন অনায়াসে কাটাতে পারেন ভার্সাইয়ের মার্জিত প্রাসাদে। পানভোজনের জন্য ফরাসিদের সুনাম দুনিয়াজোড়া। তাই সুস্বাদু খাবার ও পানীয় ধীরসুস্থে চেখে দেখার জন্য আলাদা সময় হাতে রাখুন। ঐতিহ্যবাহী ফরাসি ভোজনবিদ্যা স্পর্শাতীত ঐতিহ্যের (ইনট্যানজিবল কালচারাল হেরিটেজ) তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত করেছে ইউনেস্কো। ফ্রান্সের প্রতিটি অ লের নিজস্ব স্বাতন্ত্রসূচক রন্ধনপ্রণালী ও সংস্কৃতি রয়েছে। ব্রিতানির উদ্ভট মাছধরা গ্রাম ক্রেপ কাপড় ও সমুদ্রজাত খাবারের জন্য খ্যাত। ফরাসি আল্পসে আরামদায়ক কাঠের কুটিরে পরিবেশন করা হয় কাঠের চুলায় বিশেষভাবে রান্না করা মাংসের (সাধারণত শূকর) সঙ্গে গরম গরম ‘ফনডুয়ে’। পনির গলিয়ে তৈরি মনকাড়া ‘ফনডুয়ে’ পরিবেশনেও রয়েছে বৈচিত্র্য। বহনযোগ্য উনুনে বসানো বিশেষ ধরনের পাত্রে খাবারটি গরম রাখে মোমবাতি বা স্পিরিট ল্যাম্পের উত্তাপ। মুখরোচক খাবার-দাবার ও সুগন্ধে বিমোহিত হওয়ার দুর্নিবার আকর্ষণই মানুষকে বার বারে টেনে আনে ফ্রান্সে।
আইফেল টাওয়ার
প্যারিস বা ‘পারী’ শহরের প্রতীক আইফেল টাওয়ার (ঊরভভবষ ঞড়বিৎ)। বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে বিখ্যাত দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম। সারা দুনিয়া একে আইফেল টাওয়ার নামে জানলেও ফরাসিরা একে বলে ‘লা র্তু ইফেল্’। ৮,০০০ ছোট-বড় ধাতব খÐ জুড়ে তৈরি কাঠামোটি নির্মাণকুশলতার অসাধারণ এক কীর্তি। ১৮৮৯ সালে ফরাসি বিপ্লবের শতবর্ষ উপলক্ষে প্যারিসে বসেছিল বিশ্ব¦মেলা। এই মেলার প্রবেশ তোরণ হিসেবে গুস্তাভ আইফেলের পরিকল্পনায় তৈরি হয়েছিল এই টাওয়ার। ৩২০ মিটার উঁচু টাওয়ারটি তখন নামীদামি শিল্পী-লেখক-বুদ্ধিজীবী-প্রকৌশলীসহ অনেকেরই মন জয় করতে পারেনি। কিন্তু এখন আইফেল টাওয়ার পেয়েছে অপরিমেয় জনপ্রিয়তা এবং এটি এখন প্যারিসের আকাশপ্রান্তেরও পরিচায়ক। এর অনন্য লালিত্যের জন্য ডাক নাম হয়েছে ‘আয়রন লেডি’। টাওয়ারের পর্বতপ্রমাণ আকার ও তিনস্তরের প্রতিটি ধাপ থেকেই উত্তেজনাপূর্ণ বিস্তৃত দৃশ্য দর্শনার্থীদের বিমুগ্ধ করে। প্রথম স্তর অথবা দ্বিতীয় স্তরের ওপর মিশালা-তারকাপ্রাপ্ত ‘জুলে ভার্ন’ রেস্তোরাঁয় বসে পানভোজনের সঙ্গে চারপাশের নান্দনিক সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। ২৭৬ মিটার উঁচু শীর্ষস্তর থেকে প্যারিসের সুদূরপ্রসারী অত্যাশ্চর্য দৃশ্য দেখা যায় এবং রৌদ্রোজ্জ্বল পরিষ্কার দিনে এর ব্যাপ্তি ৭০ কিলোমিটার ছাড়িয়ে যায়।
ল্যুভর জাদুঘর
ফরাসি রাজাদের পুরনো প্রাসাদেই গড়ে উঠেছে ল্যুভর জাদুঘর (খড়াঁৎব গঁংবঁস)। এই অতুলনীয় জাদুঘরটি ইউরোপীয় শিল্পকলার এক শীর্ষস্থানীয় সংগ্রহশালা। লিওনার্দো দ্য ভিি র ‘মোনা লিসা’, ভেরোনিসের ‘ওয়েডিং ফিস্ট অ্যাট কানা’, খ্রিস্টপূর্ব প্রথম শতাব্দীর ‘ভেনাস ডি মাইলো’ ভাস্কর্যসহ পশ্চিমা সভ্যতার সবচেয়ে বিখ্যাত সৃষ্টির অনেকগুলোই এখানে রয়েছে। জগদ্বিখ্যাত শিল্পীদের গড়া বিপুল এই কীর্তির বেশিরভাগই ছিল আবার এই প্র্রাসাদে বাস করা রাজাদের সম্পদ। এছাড়া ভ্যাটিকান ও ভেনিস প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে ফ্রান্সের চুক্তি ও প্রথম নেপোলিয়নের ভাÐারে পাওয়া অনেক শিল্পকর্মেরও এখানে ঠাঁই হয়েছে। ল্যুভরে অগণিত শ্রেষ্ঠতম সৃষ্টিসহ ৩০,০০০ শিল্পকর্মের রয়েছে অভ‚তপূর্ব সংগ্র্রহ। বিশ্বসেরা এমন সব সৃষ্টিকর্ম একদিনে বা এমনকি এক সপ্তাহের মধ্যেও পুরোপুরি দেখা সম্ভব নয়। এজন্য সবচেয়ে ফলপ্রসূ অভিজ্ঞতার জন্য এই শিল্পভাÐারে সংরক্ষিত প্রধান প্রধান সৃষ্টিকর্মের সংক্ষিপ্ত তালিকা করে মনোনিবেশ করুন।
ভার্সাই প্রাসাদ

শুধুমাত্র রাজকীয় একটি প্রাসাদই নয়; ফরাসি রাজতন্ত্রের মহিমা তুলে ধরতেই করা হয়েছিল ভার্সাইয়ে এই প্রাসাদ তৈরির পরিকল্পনা। ‘সূর্যের রাজা’ চতুর্দশ লুই তার বাবার ছোট্ট শিকারগৃহটিকে ঐশ্বর্যবান বারোক শৈলী ও অভ্যন্তÍরীণ সাজসজ্জায় সুরম্য এক প্রাসাদে রূপান্তরিত করেন। চতুর্দশ লুই এর পরম ক্ষমতার প্রতীক ও ইউরোপে রয়্যাল কোর্টের আদর্শ এই প্রাসাদ। স্থপতি জুল আরদুঁয়া মঁনসার (ঔঁষবং ঐধৎফড়ঁরহ-গধহংধৎঃ) সুনিপুণ দক্ষতায় একে রাঙিয়েছেন অপরূপ সাজে। বিখ্যাত ‘হল অব মিরর’ বা আয়না মহলে রাজা তার রাজকীয় ক্ষমতা প্রদর্শনের মাধ্যমে দর্শকদের বিমুগ্ধ করতেন। আর হলের জানালা গলে সূর্যালোক ভেতরে প্রবেশ করে দেয়ালে ঝোলানো বাহারি আয়নায় প্রতিফলিত হয়ে স্ব^র্ণালী আলোকচ্ছটায় চারপাশ ভরিয়ে তুলতো। ভার্সাই প্রাসাদ (চধষধপব ড়ভ ঠবৎংধরষষবং) আলংকারিক জলাশয়, পুরোপুরি ছাঁটা গুল্ম এবং আকর্ষণীয় ঝরনা সমন্বিত প্রথাগত ফরাসি উদ্যানের জন্যও বিখ্যাত। দু’ভাগে বিভক্ত উদ্যানটির একপ্রান্তে রানি আমলে দো মারি অনতোয়ানেত (গধৎরব-অহঃড়রহবঃঃব’ং যধসষবঃ) ‘খেলাঘর’। রাজসভার প্রথা ও মেকি সামাজিকতা সইতে না পেরে সেখানেই একান্তে সময় কাটাতেন মারি।

কোত দা জ্যুর
ফ্রান্সের সবচেয়ে পরিপাটি ও প্রসারিত তটরেখা কোত্ দাজ্যুর (ঈষ্ঠঃব ফ’অুঁৎ); ঠিক যেন এক মায়াজাল! ভ‚মধ্যসাগরের সম্মোহিত গভীর নীল রঙের জল আছড়ে পড়ছে বেলাভূমিতে। সেজন্যই দক্ষিণা লীয় কোত দা জ্যুরের আরেক নাম ‘নীল উপক‚ল’। ফরাসি রিভিয়েরা খ্যাত কোত দা জ্যুর; সাঁ-ত্রোপেজ বা সেন্ট ট্রোপেজ থেকে ইতালি সীমান্ত সংলগ্ন মেন্টন পর্যন্ত বিস্তৃত। গ্রীষ্মকালে সমুদ্রতীরবর্তী তামাম রিসোর্ট সৈকতপ্রেমী ও ‘সূর্যপূজারীদের’ ভিড়ে কানায় কানায় ভরে ওঠে। দুনিয়ার ধনী ও বিখ্যাত ব্যক্তিরাও ছুটে আসেন এখানকার নিজস্ব বিলাসবহুল ভিলায়; বিলাসী প্রমোদতরীতে চষে বেড়ান নীল জলের বুকে। সৈকতনগরী নিসের (ঘরপব) সুনাম সাগরের অপরূপ সৌন্দর্য ও নক্ষত্র জাদুঘরের জন্য। কান (ঈধহহবং) ঐতিহ্যবাহী চলচ্চিত্র উৎসব ও কিংবদন্তির হোটেল-রেস্তোরাঁর জন্য বিখ্যাত। আলো-ঝলমলে উপকূলীয় এমন এক শহরের পাশেই সেরা বালুকাময় সৈকতঘেরা শহর আন্তিব (অহঃরনবং)। সাঁ-ত্রোপেজে দৃষ্টিনন্দন সৈকতে বেড়ানো ছাড়াও রয়েছে স্থানীয়দের সঙ্গে মাছধরা উপভোগের দারুণ সুযোগ। আর একচেটিয়া বাতাবরণ ও অত্যাশ্চর্য সৌন্দর্য নিয়ে দুহাত বাড়িয়ে সবাইকে ডাকছে মোনাকো।

মোঁ সাঁ-মিশেল
নর্মান্ডির উপকূলে সাগরের বুকে নাটকীয়ভাবে জেগে ওঠা দ্বীপ মোঁ সাঁ-মিশেল বা মন্ট সেন্ট-মিচেল। এটি ফ্রান্সের সবচেয়ে আকর্ষণীয় দর্শনীয় স্থানগুলোর অন্যতম। এই ‘সমুদ্র পিরামিড’ যেন রহস্যময় এক চোখ; পাথুরে ক্ষুদ্র দ্বীপটি দেয়াল ও বুরুজ দ্বারা পরিবেষ্টিত। জোয়ারের সময় পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ মোঁ সাঁ-মিশেল। আর ভাটার সময় বালুকাময় বেলাভ‚মিতে অনায়াসেই হেঁটে বেড়ানো যায়। এর প্রধান পর্যটক আকর্ষণ ‘অ্যাবে ডি সেন্ট-মাইকেল’। কথিত আছে, ৭০৮ সালে আভ্রঁশের আর্চবিশপ ঔবার্ট এটি প্রতিষ্ঠার পর শ্রেষ্ঠ দেবদূতদের একজন মাইকেল স্বপ্নে তার কাছে হাজির হন। সমুদ্রের বুকে ১৫৫ মিটার উঁচু এই মঠের গথিক চ‚ড়া মধ্যযুগীয় স্থাপত্যের এক অপার বিস্ময়। চমৎকার এই স্থাপনাটি চুনাপাথরের মহিমান্বিত একটি অভয়ারণ্যও। ১১ শতকে নির্মিত হওয়ার পর পরই মঠটি গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থানে পরিণত হয়। মোঁ সাঁ-মিশেল ভ্রমণে আত্মায় সুনির্মল প্রশান্তি নেমে আসে; সেজন্য দ্বীপটি ‘স্বর্গীয় জেরুজালেম’ নামেও পরিচিত।

লোয়ার ভালে শাতো

লোয়ার ভালে শাতো ভ্রমণ যেন শিশুদের রূপকথার গল্পের বইয়ের পাতায় পাতায় ঘুরে বেড়ানো। অরণ্য ও নদীবেষ্টিত উপত্যকাটির গ্রামীণ পথেঘাটে ছড়ানো রূপকথার দুর্গ-পরিখা-গম্বুজ। ‘ফ্রান্সের বাগান’ হিসেবেও পরিচিত এই ভ্যালি। নানা বর্ণ ও গন্ধের হরেক স্বাদের পানীয় তৈরির জন্য খ্যাত এই উপত্যকা ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবেও তালিকাভুক্ত। লোয়ার উপত্যকায় মধ্যযুগীয় কয়েকটি দুর্গ পাহাড়ের চ‚ড়ায় নির্মিত এবং সুরক্ষার জন্যও পাহাড়বেষ্টিত। সবচেয়ে বিখ্যাত লোয়ার শাতো বা লোয়ার দুর্গটি রেনেসাঁস আমলের ঐশ্বর্যশালী স্থাপত্যের নির্দশন এবং আনন্দ ও বিনোদনের ভাবনা মাথা রেখেই এর নকশাটি করা হয়েছিল। দুর্গটি প্যারিসের বাইরে আদালত জীবনের সস্প্রসারণ হিসেবে বিবেচিত হয়। শ্যাতো দে শামবর রাজা প্রথম ফ্রান্সিসের জন্য নির্মিত হয়েছিল এবং এটিই সবচেয়ে চমৎকার ও দৃষ্টিনন্দন। শ্যাতো দো শেওলোনশো (ঈযব্জঃবধঁ ফব ঈযবহড়হপবধঁ) রয়েছে স্বতন্ত্র মেয়েলি শৈলী আর শোভ্যারনি যেন শান্ত ও মনোরম পরিবেশে জমিদারের কমনীয় কোন খামার বাড়ি।

কাতেড্রাল নোত্র-দাম
আট শতাব্দীরও বেশি সময় ধরে কাতেড্রাল নোত্র-দাম গির্জার বিশালতা বিশ্বাসীদের অনুপ্রাণিত করেই চলেছে। কেউ কেউ বলেন, এই গির্জার উত্তেজনাপূর্ণ সূ² সৌন্দর্য সংশয়বাদী অনেকের মনে আবারও বিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত গির্জাটি মধ্যযুগীয় গথিক স্থাপত্য বৈভবের প্রকৃষ্ট উদাহারণ। ২,৫০০ বর্গমিটার আচ্ছাদিত সুবিশাল ক্ষেত্রে উজ্জ্বল রঙিন-কাচের জানালা গলিয়ে আসা বর্ণিল আলোয় স্বর্গীয় আভা তৈরি হয়। ১৩ শতকে তৈরি অনেক জানালার গায়ে সুনিপুণ কারুকার্যে বাইবেলের কাহিনি অবিশ্বাস্য দক্ষতায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ‘গোলাপ জানালা’ তার দৈত্যাকৃতি ও খুঁটিনাটির জন্য বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এছাড়া সুপ্রাচীন শৈলী ও অভিব্যক্তির জন্য ‘প্যাশন উইন্ডো’ ও ১২ শতকে নির্মিত ‘বøু ভার্জিন উইন্ডো’ও সমান গুরুত্ববহ। এপ্রিল থেকে অক্টোবর পর্যন্ত রাতের আকাশের অত্যুজ্জ্বল মায়াবী আলোর ভেলায় ভেসে বেড়ায় কাতেড্রাল নোত্র-দাম।

প্রোভঁস

জলপাই বাগান, রোদে ভেজা ঘূর্ণায়মান পাহাড় এবং গাঢ় রক্তবর্ণ ল্যাভেন্ডার ক্ষেতের সঙ্গে পাথুরে উদ্ভিদ শোভিত প্রোভঁস (চৎড়াবহপব) এর ছোটো ছোটো গ্রামগুলো উপত্যকায় ঘেরা। এর স্পন্দনশীল দৃশ্যাবলীর চমকে পল সেজান, হেনরি মাতিস, মার্ক শাগাল এবং পাবলো পিকাসোসহ ভুবনবিখ্যাত অনেক শিল্পীই বিমুগ্ধ হয়েছিলেন। প্রোভঁসে দেহাতি প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও গ্রামীণ আবহের নিখুঁত মিশ্রণের জন্য শিল্পই হলো জীবনধারণের উপায়। খোয়া বিছানো রাস্তায় ব্যস্ততাহীন হাঁটাহাঁটি কিংবা বহিরাঙ্গনের ক্যাফে সোপানে হাসিমুখে রোদ পোহাতে পারেন। রঙিন খোলা বাজারে যান এবং জলপাই তেল, সবজি ও সুগন্ধী শাকসবজির সুস্বাদু খাবারের স্বাদ পরখ করুন। এক্স-অঁ-প্রোভঁস (অরী-বহ-চৎড়াবহপব) এখানকার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বাজার শহর। আর্ল (অৎষবং) চিত্তাকর্ষক প্রাচীন ধ্বংসাবশেষ ও ঐতিহ্যবাহী উৎসবের জন্য খ্যাত। আভিনিঞ (আরমহড়হ) পোপের মধ্যযুগীয় শহর ছিল। এমনকি সেন্ট পল-দ্য-ভেন্স, সাঁ-রেমি বা সেন্ট-রেমি এবং গর্দোঁর মতো ছোট ছোট গ্রামে রয়েছে আশ্চর্য সুন্দর ঐতিহাসিক স্থাপনা, চমৎকার জাদুঘর এবং অনিশ্চিত অদ্ভুত পরিবেশ।

শামোনি মোঁ বøঁ

ফরাসি আল্পসের মোঁ বøঁ বা মন্ট বøাঙ্ক পর্বত থেকে চোখে পড়ে বিস্ময়কর অবিস্মরণীয় দৃশ্য। ইউরোপের সর্বোচ্চ পর্বত মোঁ বøঁ; ফ্রান্স ও ইতালির সীমান্ত জুড়ে বিস্তৃত। মোঁ বøঁ বা ‘শুভ্র পর্বত’ এর উচ্চতা ৪ হাজার ৮১০ মিটার এবং এটা সবসময় বরফাবৃত থাকে। পাহাড়ের স্বর্গীয় শিখরের নিচে প্রথাগত আল্পাইন গ্রাম শামোনি (ঈযধসড়হরী) সুউচ্চ পার্বত্য উপত্যকায় ঘেরা। এই মায়াবী ছোট্ট শহর ঐতিহাসিক গির্জা, আরামদায়ক কাষ্ঠনির্মিত কুটির রেস্তোরাঁ এবং মনোরম সরাইখানায় পরিপূর্ণ। শামোনি স্কিইং, পাহড়ে ভ্রমণ, পর্বতপার্শ্বে আরোহণ এবং দুঃসাহসিক অভিযান বা শুধু ঝিম মেরে বসে থাকার জন্য আদর্শস্থান। নির্মেঘ আকাশ ও নৈশব্দের মাঝে কখন যে সময় কেটে যাবে তা টেরই পাবেন না। এছাড়া আলু, পনির এবং ‘ফনডুয়ে’র সঙ্গে ফরাসি বিশেষ কায়দায় রান্না করা সুস্বাদু মাংস চেখে দেখতে পারেন।

আল্‌জাসের গ্রাম

আল্‌জাসের (অষংধপব) সবুজ ঘূর্ণায়মান পাহাড়ের মাঝে ছড়ানো অপরূপ সুন্দর বেশ কয়েকটি ফরাসি গ্রাম। ভোজ পর্বতমালা থেকে জার্মান সীমান্তে রাইন নদীর অববাহিকা পর্যন্ত এর বিস্তৃতি। রঙ পেন্সিলে আঁকা সুচিত্রিত এই গ্রামগুলোতে দেখা মিলবে সুন্দর ছোট্ট প্যারিশ গির্জার চারপাশ জুড়ে আধা-কাঠের ঘরবাড়ি। পুষ্পশোভিত আনন্দদায়ক ঝুল বারান্দা ও খোয়া বাঁধানো রাস্তা পথচারীদর মনে যোগ করবে বাড়তি আনন্দ। এই গ্রামগুলোর মধ্যে বেশ কয়েকটি ফরাসি ‘ভিলা ফ্লরি’ (ফুলের গ্রাম) পুরস্কার জিতেছে; এর মধ্যে রয়েছে বুরগ্যার বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ঘরবাড়িওয়ালা ওবারনাই, পুষ্পবিছানা-শোভিত রিবোভিল, শিল্প ও ইতিহাসের শহর গিবভিলা এবং চিত্তাকর্ষক মধ্যযুগীয় গ্রাম ব্যারগাইম। এছাড়া আল্জাসের গ্রামগুলোর কয়েকটি পেয়েছে প্লু বøু ভিলাজ ডি ফ্রঁসও (চষঁং ইবধীঁ ঠরষষধমবং ফব ঋৎধহপব) বা ফ্রান্সের সর্বাধিক সুন্দর গ্রামের স্বীকৃতি; এর মধ্যে রয়েছে অসাধারণ ঐতিহাসিক ঘরবাড়ির জন্য গল্পগ্রন্থ হ্যামলেট হিসেবে চিহ্নিত গিবভিলা, উপত্যকায় ঘেরা এখনও আকর্ষণীয় এগিশাইম এবং উত্তম পানভোজন এবং সরল, শান্ত ও মনোরম দৃশ্যাবলীর জন্য সুপরিচিত মিটেল বারগাইম। কোলমার আল্জাসের গ্রামা ল ও পার্শ্ববর্তী প্রাকৃতিক সৌন্দর্য অনুসন্ধানের একটি আর্দশ স্থান।

কার্কাসেন

গম্বুজবিশিষ্ট স্তম্ভ ও খাঁজকাটা কেল্লায় ঘেরা কার্কাসেনকে (ঈধৎপধংংড়হহব) রূপকথার গল্প থেকে সরাসরি বেরিয়ে আসা এক শহর বলে মনে হয়। এই সুরক্ষিত (পুনঃনির্মিত) শহর দর্শনার্থীদের মধ্যযুগে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। দুর্গশহর শিতে সংকীর্ণ ও খোয়া বিছানো রাস্তা এবং ব্যতিক্রমধর্মী পুরনো ঘরবাড়িতে পুরোপুরি ঘেরা এক আজব দুনিয়া। এর প্রতিটি রাস্তা, চত্বর এবং ভবনের মধ্যযুগীয় বৈশিষ্ট্য অপরিবর্তিত রাখা হয়েছে। অবশ্যই দেখার মতো পর্যটন কেন্দ্র দ্বিস্তর-কেল্লা সুরক্ষা ব্যবস্থাসহ ‘৫৪ টাওয়ার’ ও ১৩ থেকে ১৪ শতাব্দীতে নির্মিত কাচের জানালাওয়ালা সুদৃশ্য শাঁ নাজ্যার ক্যাথিড্রাল। এছাড়া কার্কাসেন ১৪ জুলাই বাস্তিল দিবসের আতশবাজি দেখার জন্য চমৎকার জায়গা।

ব্রিতানি

ফ্রান্সের উত্তর-পূর্ব উপক‚লের সুন্দর ঐতিহাসিক অ ল ব্রিতানি (ইৎরঃঃধহু)। পাথুরে সমুদ্রতীরবর্তী রিসোর্ট থেকে নৈসর্গিক দৃশ্য, আজব মাছধরা গ্রাম এবং পোক্ত সমুদ্রবন্দর এই অ লের বৈশিষ্ট্য। প্রাচীন ঐতিহ্যের জন্য গর্বিত ব্রিতানি ধর্মীয় পোশাক পরা উৎসবের জন্য সুখ্যাত। কেলটিক প্রভাব ও গ্যেলিক সম্পর্কিত একটি উপভাষার সঙ্গে জড়িত কিংবদন্তি ও পৌরাণিক কাহিনির রহস্যময়তা আজও এই অ লে ছড়িয়ে রয়েছে। এছাড়াও সুস্বাদু রান্নার জন্য খ্যাত ব্রিতানি; এখানকার মসলাদার প্যানকেক ও মিষ্টি ডেজার্ট প্যানকেক সুপরিচিত। প্রশান্ত মহাসাগরীয় বন্দরনগরী সাঁ-মালো প্রাচীন প্রাচীরবেষ্টিত। এই অ লের ছবির মতো সুন্দর-সাজানো একটি শহর কামপের; সুদর্শন অর্ধ-কাষ্ঠনির্মিত বাড়িঘর, মনোরম চত্বর এবং চিত্তাকর্ষক গথিক ক্যাথিড্রাল ঐতিহাসিক এই শহরটির অন্যতম আকর্ষণ। সলোঁ দো তে দর্শনীয় শ্যাতো বা দুর্গ দেখতে প্রতিদিন অসংখ্য পর্যটক ভিড় জমান। ১৫৯৮ সালে স্বাধীনভাবে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম পালনের অনুমতিপত্র বা নঁতের ফরমান (ঊফরপঃ ড়ভ ঘধহঃবং) এই শ্যাতোতেই সই হয়েছিল। তাছাড়া আদিম বালুকাময় সৈকত, অতি ক্ষুদ্র দূরবর্তী দ্বীপ ও প্রাগৈতিহাসিক দুর্গ ব্রিতানির অন্যান্য জনপ্রিয় স্থানের মধ্যে উল্লেখযোগ্য।

বিয়ারিত্জ
ফ্রান্সের বাস্ক কাউন্টিতে অপরূপা বিস্কে উপসাগরের তীরবর্তী কেতাদুরস্ত সৈকত শহর বিযারিত্জ (ইরধৎৎরঃু)। নির্মল ও সমারোহপূর্ণ বাতাসে প্রাণভরে নিশ্বাস নিতে এই শহরের সমুদ্রতীরবর্তী রিসোর্টে সারাবছরই ভিড় লেগেই থাকে। স¤্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের স্ত্রী স¤্রাজ্ঞী ইউজেনির দারুণ পছন্দের স্থান ছিল বিযারিত্জ। অবকাশ কাটাতে প্রায়ই সপরিবারে এই সৈকতে আসতেন তিনি। রাজপরিবারের দ্বিতীয়-সা¤্রাজ্য-শৈলীর সুবিশাল প্রাসাদকেই বিলাসবহুল ‘হোটেল দ্যু প্লাসিসে’ রূপান্তরিত করা হয়েছে। মিশলা (গরপযবষরহ) তারকাচিহ্নিত রেস্তোরাঁসহ বিলাসবহুল এই হোটেল থেকে গ্র্যান্ড প্লাস সৈকতের দুর্দান্ত দৃশ্য উপভোগ করা যায়। সেজন্যই এর সমুদ্রমুখী প্রশস্ত বালুকাময় সৈকত ‘বেল এপিওক’ থেকে উচ্চ-সমাজের অবকাশগামীদের আকৃষ্ট করছে। মহাসাগরের সঙ্গে সম্পর্কিত অবশ্যই দর্শনীয় অন্যান্য স্থানের মধ্যে সমুদ্র জাদুঘর বা মিউজিয়াম অব দ্য সি, বাতিঘর এবং আটলান্টিকের বন্য ঢেউয়ের আঘাতে তটরেখা বরাবর অপরিমেয় শিলার ওপর দাঁড়ানো ভার্জিন রকচিত্র রয়েছে। এই শহরের রাজকীয় অতীতের স্বাদ পেতে ঘুরে আসতে পারেন বিলাসবহুল চায়ের দোকান মিরমন্টে। ১৮৭২ সাল থেকে ব্যতিক্রমী পেস্ট্রি সরবরাহ করা হচ্ছে অভিজাত এই দোকানে।

রোকামাঁদুর

সমুদ্রসৈকতে দুরারোহ পর্বতগাত্রে নিছক চুনাপাথরের খাঁজে আকাশ ও পৃথিবীর মধ্যে ঝুলে থাকা অবিস্মরণীয় পবিত্র স্থান রোকামাঁদুর (জড়পধসধফড়ঁৎ)। ১১ শতকে জেরুজালেম ও রোমের পর খ্রিস্টীয়জগতে এই তীর্থস্থানটি ছিল তৃতীয় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ গন্তব্য। এছাড়া মধ্যযুগে স্পেনের সান্তিয়াগো দে লা কম্পোসটেলায় যাত্রা পথে বেশিরভাগ তীর্থযাত্রীই এখানে যাত্রাবিরতি করতেন। এই গ্রামে সাতটি প্রাচীন অভয়াশ্রম রয়েছে। কিন্তু তীর্থযাত্রীরা শ্যাপেল নোত্র-দামে সংরক্ষিত বø্যাক ভার্জিনে শ্রদ্ধাজ্ঞাপনের জন্য হামলে পড়েন। আখরোট কাঠে খোদাই করা কুমারি মেরির (ঠরৎমরহ গধৎু) এই অমূল্য কালোচিত্রটি শতকের পর শতক ধরে অলৌকিকভাবে অবিকল রয়েছে। এখানকার আরেকটি অবশ্যই দর্শনীয় স্থান ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত ইধংরষরয়ঁব ঝধরহঃ-ঝধাঁবঁৎ। রোকামাঁদুরের বৃহত্তম এই গির্জাটি রোমান ও গথিক বিশেষ ধরনের স্থাপত্য শৈলীতে ত্রয়োদশ শতাব্দীর মাঝামাঝিতে নির্মিত হয়। এছাড়া চ্যালেঞ্জিং আধ্যাত্মিক অভিজ্ঞতার জন্য তীর্থযাত্রীরা খাড়া ধাপ বেয়ে গ্রামের সর্বোচ্চ বিন্দুর শ্যাতোতে ক্রুসের ১২ স্টেশন’-এ (১২ ঝঃধঃরড়হং ড়ভ ঃযব ঈৎড়ংং) আরোহণ করতে পারেন। রোকামাঁদুর লিমোজস থেকে প্রায় ১৪৫ কিলোমিটার দূরে ডর্ডোংনে অ লের একটি প্রাকৃতিক পার্ক।

লাসকো-র প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র

ফ্রান্সের দক্ষিণ-পশ্চিমের লাসকোতে (খধংপধীঁ) দর্শনার্থীরা প্রাগৈতিহাসিক শিল্পের আকর্ষণপূর্ণ জগতে হারিয়ে যেতে পারেন। এখানে মিলেছে বিশ্বের প্রতœপ্রস্তরযুগীয় শিল্পের শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ইউনেস্কোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত এই স্থাপনাটি আকিতেন অ লের ভেজ্যার উপত্যকায়। ১৯৪০ সালে আবিষ্কৃত লাসকো গুহায় রয়েছে সূ² প্রাগৈতিহাসিক দেয়ালচিত্র। কিন্তু ছবিগুলোর নষ্ট হওয়া ঠেকাতে গুহাটি বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। তবে দর্শকদের চাহিদা মেটাতে আসল গুহার ২০০ মিটার দূরে মডেল গুহা তৈরি করা হয়েছিল; এবার প্রায় ৮০০ মিটার দূরে খোলা হয়েছে তৃতীয় লাসকো গুহা। লাস্কোর মডেল গুহায় পুরাতন প্রস্তরযুগের খাঁটি গৈরিক বর্ণের পশুর চিত্রকলার প্রতিটি বিস্তারিতসহ সতর্কতার সঙ্গে পুনরুৎপাদন করা হয়েছে। শত শত আঁকা ও খোদাই করা জীবজন্তুর ছবি পাওয়া গেছে লাস্কোয়। এর মধ্যে প্রায় ৬০০ জীবজন্তুকে ইতোমধ্যেই শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে; যেমন ষাঁড়, ঘোড়া, হরিণ এবং ভালুক। লাসকোর গুহামানবদের আঁকা দেয়ালচিত্রের হুবহু নকল করে দ্বিতীয় মডেল গুহা বা নতুন আন্তর্জাতিক কেন্দ্রটিতে রাখা হয়েছে। ইস্পাতের ওপর অ্যাক্রিলিক রেজিন লেপে তৈরি নকল পাথরের দেয়ালে আসল লাসকো গুহার দেয়ালচিত্রগুলো নিখুঁতভাবে আঁকা হয়েছে। তাই দর্শনার্থীরা এগুলোর সঙ্গে মূল গুহাচিত্রের কোন পার্থক্য করতে পারবেন না। লাসকো দুই নামের প্রথম মডেলটিও ইতোমধ্যেই সারাতে হয়েছে। নতুন মডেলটি শুধু লাসকো গুহার কপি বা অনুরূপ নয়। এখানে লাসকোর ইতিহাসও ডিজিটাল পদ্ধতিতে প্রদর্শন করা হয়; যেমন কিভাবে চার কিশোর লাসকো গুহাটি আবিষ্কার করে। ৭৭ বছর পরও লাসকোর সব রহস্য ভেদ করা সম্ভব হয়নি। সেই লাসকো গুহা আজ আধুনিক শিল্পকলারও প্রেরণা।

অদিতি আহমেদ