/পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ, ইরান 

পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ, ইরান 

সাইদুল ইসলাম

আনন্দ, ভালোলাগা আর রূপময় স্বপ্নীল পৃথিবীর অজানা কোন সৌন্দর্যের হাতছানিতে ক্ষণিকের জন্য হারিয়ে যেতে মন ছুটে চলে পাহাড়, নদী, সাগর ও অরণ্যে। কখনও মন চায় কোনও শিল্পকর্মের সুনিপুণ কারুকার্যে মন রাঙাতে। আর সে মনের খোরাক জোগাতেই দূর থেকে দূরে ছুটে চলা। সে চলার পথের গন্তব্য যদি হয় ইতিহাস, ঐত্যিহ্যে সমৃদ্ধ কোন দেশ তাহলে যে একজন ভ্রমণপিপাসুর মনের ষোলকলা পূর্ণ হবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। ঠিক এমনই এক দেশের নাম হলো ইরান। বলা হয়ে থাকে, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্যের দেশ এটি। অনেকে আবার বলে থাকেন ইরানের ইসফাহান শহর দেখলেই যেন পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য দেখা হয়ে যায়। যেমনটি ফারসিতে বলা হয়ে থাকে ‘শাহরে ইসফাহান, নেসফে জাহান’। 

সত্যিই তাই, পৃথিবীর অর্ধেক সৌন্দর্য নিয়ে এক ঘোরলাগা প্রাকৃতিক মহুয়াবন, জনশূন্য বিরান মরুভূমি আর এবড়ো-থেবড়ো সুউচ্চ পাহাড়ের কোল ঘেষে অবস্থান করছে ইসফাহান প্রদেশ। এখানকার উঁচু পাহাড়গুলোর মধ্যে রয়েছে বিদকান এবং সিমানসাফে। সাফাভি শাসনামলের ইরানের রাজধানী ইসফাহানের সৌন্দর্যের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলি আর ইমাম স্কয়ারে ইমাম মসজিদের কারুকার্যময় দেয়ালচিত্র ও চোখধাঁধানো রং-বেরঙের হাজারও বাতির আলোর নাচন কিংবা ‘নাকশে জাহান’-এর স্ফটিকশুভ্র আলোগুলো যেকোন পর্যটককে মুগ্ধ করবে।

ইসফাহান শহরের মাঝখান দিয়ে বয়ে গেছে যায়াইন্দে রুদ নদী। নদীটি শহরটিকে দু’ভাগে ভাগ করে দিয়েছে। নদীটি পূর্ব-পশ্চিমে প্রবাহিত হওয়ায় শহরটি উত্তর-দক্ষিণে বিভক্ত হয়েছে। কেন্দ্রীয় ইরানের মধ্যে সবচেয়ে জলটৈটুম্বুর নদী হলো এই যায়াইন্দে রুদ। এ নদীর ওপর তৈরি করা হয়েছে খাজু ব্রিজ বা সেতু, আল্লাভারদিখান সেতু বা সি ও সেহ সেতু ও  শাহরেস্তান সেতু যা সত্যি দেখবার মতো। সি ও সেহ পুল বা তেত্রিশ দ্বার বা গেইটবিশিষ্ট সেতুটি দৈর্ঘ্যে তিনশ’ মিটার আর প্রস্থে চৌদ্দ মিটার। যাইয়ান্দে রুদের ওপরে যতগুলো সেতু আছে সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে লম্বা সেতু এটি। ইসফাহান শহরে নদীটির ওপর অসংখ্য সেতু ও নদীর দুইপাড় বাধাই করার পাশাপাশি পানির ফোয়ারা ও ফুলের বাগান দিয়ে নদীর দুই ধার এমনভাবে সাজানো হয়েছে, যেখানে কোন পর্যটক এলে নিঃসন্দেহে তার হৃদয়-মন প্রশান্তিতে ভরে যাবে। এছাড়া এই শহরে রয়েছে বিখ্যাত ফ্লাওয়ার ও বার্ড গার্ডেন। কেউ ইসফাহানের এ দুটি গার্ডেন পরিদর্শন করেছেন, অথচ তা তাঁর স্মৃতির মণিকোঠায় ঠাঁই করে নেয়নি তা যেন একেবারেই অবিশ্বাস্য ব্যাপার। পৃথিবীর এমন কোন প্রজাতির ফুল নেই যা ইসফাহানের ফ্লাওয়ার গার্ডেনে পাওয়া যাবে না। একইসাথে আপনি যদি ইসফাহানের বার্ড গার্ডেন পরিদর্শন করেন তাও যে আপনার হৃদয়-মন ভরিয়ে দেবে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। বার্ড গার্ডেন পরিদর্শনকারীর চারপাশে বিচিত্র রকমের পাখি উন্মুক্তভাবে ঘুরে বেড়ানোর দৃশ্য যে কোন পর্যটকের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে বাধ্য। 

একইভাবে ইরানের আরেকটি আকর্ষণীয় নগরী শিরাজের কথা না বললেই নয়। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও কাব্য-সাহিত্যের ডানায় ভর করে সম্ভবত পৃথিবীর আর কোনো স্থান এত জনপ্রিয় হয়নি কখনও।

শিরাজ ইরানের দক্ষিণ-পশ্চিমে ফার্স প্রদেশে অবস্থিত। যাকে বলা হয় গোলাপ, বাগান ও বুলবুলের শহর। যদিও বিশ্ব জনমানসে শিরাজের বেশি পরিচিতি কবি ও কবিতার শহর হিসেবে। কবিরাই হচ্ছে ইরানের বুলবুল, যাদের গান পৃথিবীর কবিরা আজও ফেরি করে ফেরে। বলা হয়, ইরানেরই আরেক নগরী নিশাপুর (ওমর খৈয়ামের জন্মভূমি) ছাড়া আর কোনো শহর বিশ্বজোড়া এত খ্যাতি লাভ করেনি। শিরাজের যেসব কবি-সাহিত্যিকের কাব্যকৃতী আজো পৃথিবীতে অম্বন, তাঁদের একজন সা’দী শিরাজী এবং অপরজন ‘বুলবুল-ই-শিরাজ’ বা ‘শিরাজের বুলবুল’ বলে খ্যাত মহাকবি হাফিজ।

ইরানের দর্শনীয় ঐতিহাসিক স্থানগুলোর অন্যতম হলো ‘তাখ্তে জামশীদ’। পাশ্চাত্যে একে ‘পার্সেপোলিশ’ নামেও অভিহিত করা হয়, যা এই ফার্স প্রদেশেই অবস্থিত। ‘তাখ্তে জামশীদ’ একটি প্রাচীন রাজপ্রাসাদ। ইরানের হাখামানশী বংশের বাদশাহদের এই নগরী প্রাচ্য সভ্যতার এক উজ্জ্বল নিদর্শন হিসেবে আজো টিকে রয়েছে। কালের বিবর্তনে এই নগরীর জৌলুশ আর নেই। তবে এর ধ্বংসাবশেষ আজো বিশ্ববাসীকে প্রাচীন পারস্য সভ্যতার শৌর্যের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের হাজার হাজার পর্যটক এই তাখ্তে জামশীদের নিদর্শন দেখার জন্য ইরানে এসে ভিড় করেন।

ইরানের শিরাজ নগরীর উত্তর-পূর্বে ৭৫ কিলোমিটার দূরে বিশাল এক সমভূমির মাঝে প্রায় আড়াই হাজার বছরের প্রাচীন ইতিহাসের সাক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তাখ্তে জামশীদের স্তম্ভশ্রেণি। 

প্রাচীন ইরানের হাখামানশী রাজবংশ ছিল খুবই বিখ্যাত। এই বংশের বিখ্যাত রাজা ছিলেন প্রথম দারিয়ুস। রাজা প্রথম দারিয়ুসের আমলে হাখামানশী সাম্রাজ্য সমৃদ্ধির সর্বোচ্চ শিখরে আরোহণ করে। তিনি ৫২২ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত শাসন করেন। দারিয়ুসই প্রথম তাখ্তে জামশীদ নির্মাণ শুরু করেন।

দেশটিতে এমন আরো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে যা একটি লেখার মধ্যে বর্ণনা দিয়ে শেষ করা সম্ভব নয়। 

দেশটিতে রয়েছে অসংখ্য বাগান। যেগুলো পরিদর্শনে যেকোন পর্যটকের মন ছুঁয়ে যাবে। দেশটির ৯টি বাগান বিশ্ব ঐতিহ্য তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। ইউনেস্কোর প্রতিবেদনে ইরানের বাগিচাগুলো সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘এই বাগিচাগুলোর ডিজাইন চারটি আলাদা আলাদাভাগে বিভক্ত। এগুলোর মাঝখানে রয়েছে পানির ব্যবস্থা যা একদিকে দৃশ্য নির্মাণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে অপরদিকে বাগানের সজ্জাকৌশল ও স্থাপত্যশৈলীর দিক থেকেও এই পানির ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ।’ ওই প্রতিবেদনে আরো এসেছে, ইরানের বাগিচাগুলো কাল্পনিকভাবে বেহেশতের বাগানের অনুসরণে তৈরি করা হয়েছে। এই বিষয়টির প্রতি ইঙ্গিত করে বলা হয়েছে, ইরানের বাগিচা নির্মাণ পদ্ধতি ও সজ্জা কৌশলের প্রভাব সুস্পষ্টভাবে ভারত এবং স্পেনের মতো দেশগুলোর বাগিচা তৈরির স্টাইলের ওপর ব্যাপকভাবে পড়েছে।

ইউনেস্কো তালিকাভুক্ত ইরানের নয়টি বাগিচা হলো : বাগে পাসারগাড, বাগে এরাম, বাগে চেহেল সুতুন, বাগে ফিন, বাগে আব্বাসাবাদ, বাগে শাযদেহ মহন, বাগে দৌলাতাবাদ, বাগে পাহলাভনপুর এবং বাগে আকবারিয়া। মজার ব্যাপার হলো, এইসব বাগিচা ইরানের বিভিন্ন অ লে বিচিত্র আবহাওয়াময় পরিবেশে নির্মাণ করা হয়েছে। 

তবে ইউনেস্কোর বিশেষজ্ঞগণ স্বীকার করেছেন, অ লগত বৈচিত্র্য, পরিকল্পনা ও ডিজাইন এবং ইরানের ঐতিহাসিক রীতি ও সাংস্কৃতিক শেকড়গুলো এই মনোনয়নের ক্ষেত্রে যে কাজ করেনি তা নয়। এই বাগিচাগুলো ইতিহাসের বিভিন্ন যুগে গড়ে উঠেছে। সেই হাখামানশীয় যুগ অর্থাৎ খ্রিস্টপূর্ব অষ্টম শতাব্দী থেকে দুই শতাব্দী আগের কাজার শাসনামল পর্যন্ত সময়কালের মধ্যে বাগিচাগুলো তৈরি করা হয়েছে। ইরানিদের বিশ্বাস ও মূল্যবোধের মাঝে বাগিচা সবসময়ই একটি পবিত্র স্থান হিসেবে সম্মানিত ও মর্যাদাময়। 

প্রাকৃতিক পরিবেশের দিক থেকে বলতে গেলে দেশটিতে যেমন রয়েছে পাহাড় আর সাগর, তেমনি রয়েছে বিশাল মরুভূমি, কোথাও নদ-নদী, আবার কোথাও সুবিস্তৃত সমতল ভূমি। ভূমি-বৈচিত্র্যের মতো এখানকার আবহাওয়াতেও রয়েছে বেশ বৈচিত্র্য। সারা ইরানে বসন্ত, গ্রীষ্ম, শরৎ ও শীতÑ এই চারটি ঋতু রয়েছে। রাজধানী তেহরানসহ বিশাল এলাকাজুড়ে যখন প্রচন্ড শীত কিংবা তুষারাবৃত তখন দক্ষিণে (পারস্য উপসাগর সংলগ্ন) দিব্যি বসন্তের হাওয়া। পাহাড়, সাগর, নদ-নদী আর জঙ্গলাকীর্ণ বৈচিত্র্যময় ভূমি এবং আবহাওয়ার কারণে ইরানে পর্যটকের ভিড়ও লেগে থাকে সারা বছর।শুধু পারস্য উপসাগরের কিশ দ্বীপ ভ্রমণ করেন প্রতি বছর ১০ লাখের বেশি বিদেশি পর্যটক। ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ইরানে বিদেশি পর্যটক এসেছেন ৫০ লাখের বেশি। এশিয়ার বহু দেশ, ইউরোপ ও উত্তর আমেরিকা থেকেই আসেন বেশি পর্যটক। ইউনেস্কোর হিসাব মতে, ইরান বিশ্বের ১০ম প্রধান পর্যটনের দেশ।

ইতিহাস-ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ এই দেশটিকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় বিশ্বের পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে ইরান সরকার এরই মধ্যে নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে।

ইরানের নাগরিক ছাড়াও বিদেশি পর্যটকদের নজর কাড়তে দেশটিতে একাধিক নিত্য নতুন ধরনের ওয়াটার পার্ক চালু হচ্ছে। সর্বশেষ ওয়াটার পার্ক চালু হয়েছে ধর্মীয় নগরী কোমে। আধুনিক বিনোদন ব্যবস্থা ছাড়াও সর্বশেষ প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছে এসব ওয়াটার পার্কে। ইরানের পৌর সরকার এধরনের বিনোদন কেন্দ্রে সবাইকে বিনোদন পেতে যোগ দেয়ার আহব্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে শিশু ও  তরুণদের কাছে ওয়াটার পার্কগুলো অত্যন্ত আকর্ষণীয়। গরমে প্রশান্তি এনে দেয় এসব আয়োজন।

ওয়াটার পার্কগুলোতে বিভিন্ন রংয়ের ব্যবহার নজর কাড়ে সহজেই। সাঁতার কাটা ছাড়াও বিভিন্ন ওয়াটার রাইড বেশ রোমা কর। রয়েছে ঝরনা। সুইমিং পুলের পাশাপাশি ধীর কিংবা দ্রুত গতির রাইড রাখা হয়েছে। এধরনের ওয়াটার পার্কে নারীরা অংশগ্রহণ করতে পারবেন ভিন্ন স্থানে যা তাঁদের জন্যে সংরক্ষিত। ইসলামি বিধি মেনে এব্যবস্থা করা হয়েছে। মাশহাদ শহরে ‘ওয়াটার ওয়েভ্স ল্যান্ড’ নামে একটি ওয়াটার পার্কে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য প্রবেশ মূল্য ধরা হয়েছে ১৭ মার্কিন ডলার। এটি মধ্যপ্রাচ্যে সবচেয়ে বড় ওয়াটার পার্ক।

মাশহাদ শহরেই আরেকটি ওয়াটার পার্ক হচ্ছে আফতাব কোস্ট পার্ক। এটি এ শহরের দ্বিতীয় বৃহত্তম ওয়াটার পার্ক। চার হাজার বর্গফুট এলাকায় ১৫ হাজার বর্গফুটের অবকাঠামো স্থাপন করা হয়েছে। সাততলার একটি কমপ্লেক্স রয়েছে। এ কমপ্লেক্সের একেকটি তলায় ভিন্ন ধরনের আয়োজনের ব্যবস্থা রয়েছে। স্পিড রাইড ছাড়াও রয়েছে ১৮ মিটার উঁচু ওয়াটারফল। পাশাপাশি জোড়া রাইড রয়েছে। স্পেস হোল ছাড়াও রয়েছে খোলা রাইড, শরীরচর্চা ছাড়াও বালির স্টিমবাথসহ রয়েছে বিভিন্ন ধরনের আয়োজন। 

ইরানে বিদেশি পর্যটকদের জন্য আতিথেয়তার কথা চিন্তা করে ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থা নতুন করে ১২৫টি চার তারকা ও পাঁচ তারকা মানের হোটেল নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। যার মাধ্যমে আতিথেয়তার দিক দিয়ে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করতে যাচ্ছে ইরান। দেশটিতে বর্তমানে ২৪টি পাঁচ তারকা, ৪৫টি চার তারকা এবং ২৫টি তিন তরাকা হোটেল রয়েছে।

ইরানের এই উদ্যোগে উল্লসিত হয়েছে আন্তর্জাতিক হোটেল মালিকপক্ষ। বিশেষ করে পারস্য উপসাগরীয় অ লের আরব দেশগুলো এরই মধ্যে ইরানে তাদের হোটেল নির্মাণ কার্যক্রম জোরদার করার পরিকল্পনা নিয়েছে। এসব দেশ ইরানের পর্যটন খাতকে অত্যন্ত সম্ভাবনাময় ও লাভজনক খাত হিসেবে বিবেচনা করছে।

ইরানের সরকারি সূত্রের খবর অনুযায়ী, এরই মধ্যে জার্মানি, গ্রিস, দক্ষিণ কোরিয়া ও সিঙ্গাপুরের বিভিন্ন হোটেল গ্রুপ আলোচনার জন্য তেহরান সফর করেছে। সম্প্রতি ইউরোপের হোটেল নির্মাণকারী সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান ‘অ্যাকর’ (অপপড়ৎ) তেহরানের ইমাম খোমেইনী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের কাছে দুটি চার তারকা হোটেল নির্মাণ করেছে। এছাড়া, সংযুক্ত আরব আমিরাতের রোতানা কোম্পানি ইরানের রাজধানী তেহরানে ৬০০ কক্ষ বিশিষ্ট একটি পাঁচ তারকা হোটেল নির্মাণ করছে।

ইরানের যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই উন্নত। রয়েছে ৩১৯টি এয়ারপোর্ট ও ১৪টি নিজস্ব এয়ারলাইন্স। রাজধানী তেহরানে রয়েছে আধুনিক পাতাল রেল। রয়েছে উন্নতমানের বাস ও ট্রেন সার্ভিস। দেশের যোগাযোগ ব্যবস্থাকে আরো আকর্ষণীয় করতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছে ইরান সরকার। সম্প্রতি ইরান রেলওয়ে কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা ট্রেন সার্ভিস চালু করেছে। এ ট্রেনের নাম দেয়া হয়েছে ‘ফাদাক’। ইরানের বিখ্যাত এ দুটি শহরের মধ্যে মাযার যিয়ারত ও ধর্মীয় তীর্থযাত্রীদের যাতায়াতে এ ট্রেন সার্ভিস বিশেষ সুবিধা দেবে। ‘ফাদাক’ ট্রেন প্রথমবারের মতো কোম থেকে মাশহাদে পাঁচ তারকা মানের ট্রেনসার্ভিস। কোম থেকে মাশহাদে এবং মাশহাদ থেকে কোমে এ ট্রেন যাতায়াতে প্রতিবার সময় লাগবে ৭ ঘণ্টা।

এ ট্রেন সার্ভিসে উন্নতমানের সেবা নিশ্চিত করা হয়েছে। পুরো ট্রেনটিই তৈরি হয়েছে ইরানে। মাশহাদের পর কোম হচ্ছে ইরানের দ্বিতীয় পবিত্র শহর। কোমে হযরত মাসুমা র. এবং মাশহাদে হযরত ইমাম রেযা র.-এর পবিত্র মাযার শরীফে লাখ লাখ ইরানি নাগরিক ছাড়াও বিদেশি পর্যটকরা যিয়ারত করতে আসেন। 

আজকাল হালাল ট্যুরিজম নিয়ে বেশ আলোচনা চলছে। মুসলিম বিশ্বের গন্ডি পেরিয়ে বিষয়টি নিয়ে পাশ্চাত্যেও আলোচনা হচ্ছে। এরকম প্রেক্ষাপটে মুসলিম বিশ্বে হালাল ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে ইরান হয়ে উঠতে পারে মূল কেন্দ্র। এমন আশার কথাও সম্প্রতি বলেছেন ইরানের কালচারাল হেরিটেজ, ট্যুরিজম অ্যান্ড হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট অর্গানাইজেশনের প্রধান মাসুদ সোলতানিফার।

তিনি বলছেন, হালাল ট্যুরিজমে ইরান সবার আগে যে জিনিস উপহার দিতে পারে তা হচ্ছে হ্যান্ডিক্র্যাফ্ট বা হস্তশিল্প। সোলতানিফারের মতে বিশ্বের পর্যটকদের জন্য ইরানের হস্তশিল্প হতে পারে আকর্ষণের অন্যতম প্রধান বস্তু। তাদের হাতে রয়েছে বিখ্যাত আকিক পাথর, নানা রঙের ক্রিস্টাল পাথর, রয়েছে ভুবনবিখ্যাত কার্পেট, মাটির পাত্র; রয়েছে আকর্ষণীয় সব ক্যালিগ্রাফির চর্চা। এসবকে কেন্দ্র করে হালাল ট্যুরিজমের জন্য নতুন পরিকল্পনা নিয়ে এগুতে চাইছে ইরান।

সময়ের পরিবর্তনে মানুষের মন বদলায়, রুচি বদলায়। সময় ও দূরত্ব অতিক্রম করে মানুষ ছুটে যায় দূরে কোথাও। একটু অবসর কাটানোর জন্য; জীবনের ক্লান্তি ঝেড়ে একটু ভালো সময় অতিবাহিত করার জন্য। কালের পরিক্রমায় মানুষ এখন দিনদিন হালাল ট্যুরিজমের দিকে ঝুঁকছেন। বিশ্বের মুসলমানরা নিরাপদ পর্যটনের সন্ধান করছেন। এদিকটা মাথায় রেখে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান পর্যটন শিল্পকে জোরদার করছে। 

দেশটি এমন পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে আগ্রহী যেখানে পাঁচ তারকা হোটেলে মদের যোগান, অশ্লীল নাচগানের আসর কিংবা খোলামেলা পরিবেশে সমুদ্রতটে সূর্যস্নানের বিপরীতে ধর্মের গন্ডি না পেরিয়েই মানুষ বিশুদ্ধ বিনোদনের সুযোগ পেতে পারে। 

আর বিশ্বের বহু মানুষ রয়েছেন যাঁরা ধর্মের গন্ডি না পেরিয়েই পর্যটনের সুযোগ নিতে চান। তাঁদের জন্য ইরান হয়ে উঠতে পারে হালাল ট্যুরিজমের কেন্দ্রবিন্দু।

ইরানের দুই পাশে রয়েছে দুই সাগর অর্থাৎ পারস্য উপসাগর ও কাস্পিয়ান সাগর। রয়েছে বিশাল মরুভূমি, পাহাড়-পর্বত, জঙ্গলাকীর্ণ জনপদ; প্রাচীন সভ্যতার নিদর্শন। রয়েছে জাতিসংঘ ঘোষিত বহু ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ। এর বাইরে রয়েছে বহু অলি, আউলিয়া, ইমাম ও সাহাবির মাযার। ইরানের মাশহাদ শহরে ইমাম রেযার যে মাযার রয়েছে তাতেই তো প্রতিদিন দেশ-বিদেশের লাখো মানুষের আগমন ঘটে। এছাড়া, আরো বহু মাযার রয়েছে। আছে কোমের মতো ধর্মীয় নগরী।

এদিকে, পর্যটকদের আকৃষ্ট করতে বিশ্বের ২৮টি দেশের ওপর থেকে ভিসাপ্রথা তুলে নিচ্ছে ইরান। পর্যটন শিল্প জোরদারের পদক্ষেপ হিসেবে ইরান এ পরিকল্পনা নিচ্ছে। ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন সংস্থার পরিচালক মাসুদ সুলতানিফার এ তথ্য জানিয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পর্যটক আকর্ষণের জন্য আমরা ৪০টি দেশকে তালিকার শীর্ষে রেখেছি। এর মধ্যে ২৮টি দেশের ভিসাপ্রথা তুলে নেয়ার ব্যাপারে প্রক্রিয়া চলছে।’ তবে কোন কোন দেশ এর আওতায় পড়বে তা জানা যায় নি।

সুলতানিফার জানান, ইরানের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ইলেক্ট্রনিক ভিসা চালুর কাজ করছে যা ‘ই-ভিসা’ নামে পরিচিত। এ ব্যবস্থা চালু হলে ভিসাপ্রথায় বড় ধরনের পরিবর্তন আসবে এবং সবাই নিজ নিজ দেশ থেকে পর্যটক ভিসার জন্য আবেদন করতে পারবেন। এছাড়া, অন অ্যারাইভাল ভিসার মেয়াদ ১৫ দিন থেকে বাড়িয়ে ৩০ দিন করার অনুমোদন দিয়েছে সরকার।

মাসুদ সুলতানিফার বলেন, যেসব দেশ ইরানি নাগরিকদের জন্য সন্তোষজনকভাবে তাদের দেশে যাওয়ার ব্যবস্থা করবে সেসব দেশের জন্য ভিসাপ্রথা বাতিল করা হবে। 

ছয়জাতি গোষ্ঠীর সঙ্গে চূড়ান্ত পরমাণু চুক্তি সইয়ের পর ইরান পর্যটন খাতে বিশেষ নজর দিয়েছে। তেহরান বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের মাত্রা পাঁচ গুণ বাড়াতে চাইছে। প্রতি বছর দুই কোটি বিদেশি পর্যটক আকর্ষণের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে তেহরান। এর ফলে এ খাতে বার্ষিক আয় বেড়ে দাঁড়াবে তিন হাজার কোটি ডলার।

বিভিন্ন সূত্র থেকে জানা যাচ্ছে, আমরিকাসহ পশ্চিমা দেশগুলোর পর্যটকরা ইরানে আসার জন্য দারুণ আগ্রহী। বিশেষ করে ইরানের বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা, পর্যটনকেন্দ্র, পাহাড়, সাগর এবং প্রকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত জায়গা বিদেশি পর্যটকদের কাছে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে। ইরান ভ্রমণের বিষয়ে মার্কিন পর্যটকদের আগ্রহ নিয়ে আমেরিকার পত্র-পত্রিকাতেও খবর বের হচ্ছে। 

ইরান হচ্ছে বিশ্বের মধ্যে অন্যতম সম্ভাবনাময় পর্যটনের দেশ যেখানে বহু প্রাচীন ও প্রাকৃতিক নিদর্শন রয়েছে। ইতোমধ্যে ইরানের ১৯টি নিদর্শনকে জাতিসংঘের ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেব ঘোষণা করেছে।

লেখক: সাংবাদিক ও লেখক