/কেমন করে হলো নাম …

কেমন করে হলো নাম …

পৃথিবীর প্রতিটি দেশ ও শহরের নামকরণের পেছনে রয়েছে নানারকম ইতিহাস কিংবা মিথ। সত্য-মিথ্যা যাই হোক, সেসব ইতিহাস বা মিথ মানুষকে আকৃষ্ট করে, নিজের শহর বা দেশের নামকরণের প্রেক্ষাপট জানতে কৌত‚হলী করে তোলে। বাংলাদেশের রয়েছে ৬৪টি জেলা। প্রতিটি জেলার নামকরণের পেছনেও রয়েছে অভিনব সব ইতিহাস। ভ্রমণপিপাসু পাঠকের আগ্রহ বিবেচনা করে ধারাবাহিকভাবে বাংলাদেশের সব জেলার নামকরণের ইতিহাস নিয়মিতভাবে এই বিভাগে প্রকাশ করা হবে। প্রথম পর্বে প্রকাশিত হলো দেশের নামরূপে ‘বাংলাদেশ’ নামের ইতিবৃত্ত।
নবী নূহ আ: সালামের সময়ে ঘটে যাওয়া মহাপ্লাবনের কথা গোটা মানবজাতি অবগত। ঐতিহাহিসক তথ্য অনুযায়ি নূহ আ: এর আমলে মহাপ্লাবনের পরে পৃথিবীতে বেচে ছিলেন মাত্র ৮০ জন মানুষ। নূহ আ: সারা পৃথিবীতে আবার বসতি স্থাপনের জন্য তাঁর সন্তানদের পৃথিবীর চারকোণায় পাঠালেন। পুত্র হামকে পাঠালেন এশীয় অ লে। হামের এক পুত্র, যার নাম হিন্দ, তিনি বসবাস করতে এলেন ভরতীয় উপমহাদেশে। তার নামানুযায়িই উপমহাদেশের নাম হলো ‘হিন্দুস্তান’। হিন্দের একজন সন্তান ছিলো, যার নাম ‘বঙ্গ’; ফারসি ভাষার ইতিহাসবিদ গোলাম হোসায়ন সালীম তার ‘রিয়াজুস সালাতীন’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন, ‘বঙ্গ’ এর নামানুসারে এই বদ্বীপের নাম হয় ‘বঙ্গ-দেশ’। ‘বঙ্গে’র সন্তানরা ‘বঙ্গাল’, পরে ‘বাঙ্গাল’ এবং বর্তমানে বাঙ্গালী নামে অভিহিত। ‘বঙ্গে’র ‘বঙ্গাল’, পরে ‘বাঙ্গাল’ এবং বর্তমানে বাঙ্গালী এবং ক্রমান্বয়ে বাংলাদেশ নামকরণেরও রয়েছে কয়েকধাপের ইতিহাস।
ইতিহাসবিদ অধ্যাপক ড. সৈয়দ আনোয়ার হোসেন ‘বাংলাদেশ’ শব্দের উৎপত্তিগত ব্যাখ্যা দিতে যেয়ে উল্লেখ করেন আর্যরা ‘বঙ্গ’ বলে এই অ লকে অভিহিত করতো বলে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবে বঙ্গে বসবাসকারী মুসলমানরা এই ‘বঙ্গ’ শব্দটির সঙ্গে ফার্সি ‘আল’ প্রত্যয় যোগ করে নামকরণ করেন ‘বাঙাল’ বা ‘বাঙ্গালাহ্। ‘আল’ বলতে জমির বিভক্তি বা নদীর ওপর বাঁধ দেয়াকে বোঝাতো। ইতিহাসবিদ আবুল ফজলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি জানান, মুসলমান শাসনামলে বিশেষ করে ১৩৩৬ থেকে ১৫৭৬ সাল পর্যন্ত সুলতানি আমলে এবং ১৫৭৬ সালে মোঘলরা বাংলা দখল করার পরে এই অ লটি বাঙাল বা বাঙালাহ নামেই পরিচিতি পায়। এরপর বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজারা দখলদারিত্বের সময় এই বাংলাকে বিভিন্ন নাম দেন। শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজুদ্দৌলাও বাংলা, বিহার, উড়িষ্যা, আসামের মতো কয়েকটি প্রেসিডেন্সি নিয়ে নাম দিয়েছিলেন ‘বঙ্গ’। বৃটিশ শাসনামলে এই অ লের নাম হয় বেঙ্গল প্রেসিডেন্সি। এরপর ১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের সময় গোটা বাংলায় একটি প্রশাসনিক বিভাজন হয়। বাংলার পশ্চিম অংশ ‘পশ্চিম বঙ্গ’ এবং পূর্ব অংশ ‘পূর্ব বঙ্গ’ নামে পরিচিতি পায়।
বৃটিশ ঔপনিবেশিক শাসন অবসানের পর ১৯৪৭ সালে বঙ্গ-প্রদেশ ভারত ও পাকিস্তানে বিভক্ত হয়। পাকিস্তানিরা পূর্ব বাংলার নাম দিতে চাইলো পূর্ব পাকিস্তান। এ নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়। আন্দোলনের ধারাবাহিকতায় ১৯৫২ সালে পূর্ব পাকিস্তানের মাতৃভাষা হিসেবে স্বীকৃতি পায় বাংলা। ১৯৫৭ সালে করাচীতে পাকিস্তানের গণপরিষদের তরুণ সদস্য শেখ মুজিবুর রহমান বক্তৃতা দেয়ার সময় ‘পূর্ব পাকিস্তান’ নামকরণের প্রতিবাদ করে বলেন, ‘পূর্ব বাংলা’ নামের একটি ইতিহাস ও ঐতিহ্য আছে। আর যদি পূর্ব পাকিস্তান নাম রাখতেই হয়, তাহলে বাংলার মানুষের জনমত যাচাই করতে হবে। তারা নামের এই পরিবর্তন মেনে নেবে কিনা- সেজন্য গণভোট নিতে হবে।
এরপর আসে ১৯৬৯ সাল। শুরু হয় আইয়ূব পতন আন্দোলন। সেসময় গণঅভ্যুত্থানে ¯েøাগান দেয়া হয় ‘বীর বাঙালি অস্ত্র ধরো, বাংলাদেশ স্বাধীন করো।’ ইতিহাস অনুযায়ি সেটিই প্রথম পূর্ব বাংলাকে ‘বাংলাদেশ’ নামে অভিহিত করা হয়। পরে ১৯৬৯ সালের ৫ই ডিসেম্বর গণতন্ত্রের মানসপুত্র হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দির ৬ষ্ঠ মৃত্যুুবার্ষিকী উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেন, ‘আমাদের স্বাধীন দেশটির নাম হবে বাংলাদেশ’। ওই বৈঠকে আওয়ামী লীগের নেতারা বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করেন। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান ‘বাংলাদেশ’ নামটি প্রস্তাব করলে তাতে সবাই একবাক্যে সায় দেন। এই নাম দেয়ার কারণ হিসেবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বলেছিলেন, ১৯৫২ সালে সংগ্রামের মাধ্যমে অর্জিত বাংলা ভাষা থেকে ‘বাংলা’, এরপর স্বাধীন দেশের আন্দোলন সংগ্রাম থেকে দেশ। এই দুটো ইতিহাস ও সংগ্রামকে এক করে ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ করা হয়।
মুক্তিযুদ্ধকালে মুজিবনগর সরকার স্বাধীনতার যে ঘোষণা প্রচার করে – তাতেও বলা হয় এই দেশটির নাম হলো ‘বাংলাদেশ’। ১৯৭২ এর ৪ নভেম্বর প্রথম সংবিধান প্রণীত ও গৃহীত হয়, এবং দেশটির সাংবিধানিক নাম দেয়া হয় ‘বাংলাদেশ’।
এছাড়াও উনিশ শতকের সাহিত্যে অবিভক্ত বাংলাকে ‘বঙ্গদেশ’ বা ‘বাংলাদেশ’ বলা হতো। বঙ্কিমচন্দ্রের সাহিত্যে ‘বঙ্গদেশ’ শব্দের উল্লেখ আছে। কাজী নজরুল ইসলাম তিরিশের দশকে তার কবিতায় ‘বাংলাদেশ’ নামটি ব্যবহার করেছেন। আবার সত্যজিতের চলচ্চিত্রেও উচ্চরিত হয়েছে ‘বাংলাদেশ’ নামটি। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাংলাকে আখ্যায়িত করেছেন ‘সোনার বাংলা’ বলে, আর জীবনানন্দ দাস বলেছেন ‘রূপসী বাংলা’।

তথ্যসূত্র : বাংলাপিডিয়া, সংশ্লিষ্ট গ্রন্থাদি ও বিভিন্ন ওয়েবপোর্টাল।

মনসুর আলি