/বরিশালের ফ্লোটিং মার্কেট

বরিশালের ফ্লোটিং মার্কেট

যারা থাইল্যান্ডের ফ্লোটিং মার্কেট নিয়ে আগ্রহ দেখান, যারা কেরালার ব্যাকওয়াটার এর ছবি নিয়ে হা-পিত্যেস করেন, তারা দেখে আসতে পারেন বরিশাল আর পিরোজপুরে জলের স্বর্গরাজ্য। গ্যারান্টি দিচ্ছি, ভুলে যাবেন জীবনের সব আক্ষেপ, গর্বে ভরে যাবে বুক- দেশে এমন সুন্দর একটি জায়গা আছে বলে। ভ্রমণকারিদের অনেকেই বলেছেন জীবনের শ্রেষ্ঠতম টুর করেছেন তারা।
বলছিলাম বরিশাল- পিরোজপুরের নদী আর গ্রামের ভেতর দিয়ে বয়ে যাওয়া খালগুলোর কথা। ধান- নদী- খাল এই তিনে বরিশাল- একথাতো অনেকেই জানে। কিন্তু অনেকেই জানিনা এ নদী-খালের মধ্যে কি অপরিসীম স্বর্গীয় সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে। বরিশালের প্রায় সব এলাকাতেই একটি নদী, নিদেনপক্ষে একটি খাল রয়েছে। ভরা বর্ষায়তো বটেই, শীতকালেও এসব খালে পানি প্রবাহ থাকে। তাই বছরভর ঘুরে বেড়ানো যায় শান্ত স্নিগ্ধ এই এলাকায়। ছোট খালের দুপাশে কোথাও ফসলের মাঠ, কোথাও পতিত ভুমি, কোথাও বা বসতবাড়ি- সব কিছুই ছবির মতো মনে হবে যেকোনো পর্যটকের কাছে। কিছুক্ষণ পরপর রয়েছে গ্রামীন ছোট বাজার। বাজারে আছে টাটকা শাকসবজি। দুপুরে খেতে চাইলে আছে তারও ব্যবস্থা।
সবচেয়ে আকর্ষণীয় যে জিনিষটি পর্যটকের মন কেড়ে নেবে তা হলো ‘ফ্লোটিং মার্কেট’ বা ভাসমান বাজার। পানিপ্রধান অঞ্চল বলে স্বভাবতই এখানকার জীবনযাত্রায় নৌকার ভুমিকা প্রবল। কতোটা প্রবল তা এখানে না এলে বোঝা যাবেনা। এই এলাকার অধিবাসীদের ব্যবসা বাণিজ্যের বড় একটা অংশ চলে জলের ওপর। আর একারনেই বরিশাল আর পিরোজপুরে গড়ে উঠেছে অনেকগুলো ভাসমান বাজার। বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীতে প্রতি শনি এবং মঙ্গলবার বসে বিশাল ধান আর চালের ভাসমান বাজার। খুব সকাল থেকেই কয়েকশ নৌকায় কারবারি এবং গৃহস্থরা ধানচাল নিয়ে আসে বিক্রির জন্য। অনেকে আসেন খালি নৌকা নিয়ে চাল কিনতে। পুরো প্রক্রিয়াটিই চলে নদীতে বসে।
ধানের বাজার ছাড়াও আছে ভাসমান সবজিবাজার। বানারীপাড়া, নাজিরপুর এর বৈঠাকাঠি, উজিরপুর এর হারতা, মাহমুদকাঠিসহ বেশ কটি জায়গায় এই সবজিবাজার রয়েছে। এখানেও স্থানীয় মানুষজন তাদের শাকসবজি নৌকায় করে এনে নৌকাতে বসেই বিক্রি করে থাকে। সকাল থেকে জমে ওঠে বাজার। স্থানীভাবে উৎপাদিত লালশাক, পালংশাক, পুইশাক, কলা, চিচিংগা, বরবটি, শশা, টমেটো, মুলা ইত্যাদি নানান সবজি দিয়ে ভরপুর থাকে নৌকার ঝাক। অসাধারন ফটোজেনিক জায়গা এটি। ফটোগ্রাফারদের স্বর্গরাজ্য। শান্ত জলের মাঝে সবজি বোঝাই নৌকাগুলোতে বেচাকেনা চলে হরদম।


কেউ যদি জুলাই থেকে অক্টোবরের মাঝে ভ্রমণ করেন তবে দেখা পাবেন অপার্থিব এক সুন্দর বাজারের। সেটা হল আটঘর এর ভাসমান পেয়ারাবাজার। বাংলাদেশের উৎপাদিত মোট পেয়ারার প্রায় ৮০ ভাগই উৎপাদিত হয় ঝালকাঠির বিভিন্ন গ্রামে। আটঘর, কুরিয়ানা, ডুমুরিয়া, বেতরা, ডালুহার, সদর ইত্যাদি এলাকার প্রায় ২৪,০০০ একর জমিতে পেয়ারার চাষ হয়। এই পেয়ারা বেচাকেনার জন্য স্বরূপকাঠির ভিমরুলিতে জমে ওঠে বাংলাদেশের সবচে বড় ভাসমানবাজার। প্রতি মৌসুমে এই বাজারে প্রায় ৫০০ কোটি টাকার বেচাকেনা হয়। প্রতিদিন সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চলে কেনাবেচা। দুর দুরান্ত থেকে পেয়রাচাষীরা বাগানের পেয়ারা নিয়ে আসেন বাজারে। ক্রেতারাও আসেন দেশের নানা প্রান্ত থেকে। সাধারনত নৌকায় থাকা পুরো পেয়ারাই এক লটে কেনাবেচা হয়। ভরা মৌসুমে এক নৌকা পেয়ারা মাত্র ৩০০ টাকায় কেনা যায়।

কোথায় কোনদিন যাবেন?

  • বানারীপাড়ার চালেরবাজার : শনিবার এবং মঙ্গলবার
  • উজিরপুরের হারতার সবজিবাজার : রবি এবং বুধবার
  • নাজিরপুর এ বৈঠাকাঠি সবজিবাজার : শনি এবং মঙ্গলবার
  • ঝালকাঠির ভিমরুলির পেয়ারাবাজার : প্রতিদিন (জুলাই থেকে অক্টোবর)
    বাজার দেখতে হলে উপরের এই দিনগুলো মিলিয়ে যাওায়া ভালো। সবগুলো বাজারই খুব সকালে বসে এবং দুুপরের মধ্যে শেষ হয়ে যায়। তাই সকালে যাওয়া উত্তম। শুধু খাল বা ক্যানেল দেখতে গেলে যেকোনো দিনই যাওায় যায়।

কিভাবে যাবেন?
বর্তমানে পদ্মা সেতুর কল্যানে খুব সহজেই বরিশাল পৌছানো সম্ভব মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে। এছাড়া ঢাকার সদরঘাট থেকে নির্দিষ্ট দিন ও সময়ে পিরোজপুরের বানারীপাড়ার উদ্দেশে লঞ্চ ছেড়ে যায়। এতে উঠে পরদিন সকালে বানারীপাড়া নামতে হবে।
এছাড়াও ঢাকার গাবতলি থেকে স্বররূপকাঠির উদ্দেশ্যে বাস যায়। বাসে বানারীপাড়া নামতে হবে।

কি করে ঘুরবেন?
বানারীপাড়া পৌছাবেন সকাল ৬ টার মধ্যে। সেখানে রেষ্টুরেন্টে নাস্তা করে নদীতীরে চলে আসুন। একটি বড় নৌকা ভাড়া করুন। বলবেন আপনি ৬-৭ ঘন্টা ঘুরবেন এভাবে- বানারীপাড়া, বৈঠাকাঠি, আটঘর-কুড়িয়ানা, ভিমরুলি ও মাহমুদকাঠি। ১০-১৫ জন বসার মতো ইঞ্জিন নৌকা ভাড়া নেবে কমবেশি ১৫০০ টাকা।

খাবারদাবার
দুপুরে কুড়িয়ানার বিখ্যাত বৌদির রেষ্টুরেন্টে (সকাল সন্ধ্যা) খেয়ে নিতে পারেন। তবে আগে অর্ডার করলে ভালো খাবার রান্না করে রাখবে। প্রত্যন্ত অঞ্চলের এই বাজারে ছোট বৌদির রেষ্টুরেন্টে কয়েকশ বিদেশী খাবার খেয়েছেন।

ফেরার সময় বানারীপাড়া থেকে বাসে করে চলে আসুন গুঠিয়া। গুঠিয়ার বিখ্যাত বায়তুল আমান মসজিদ দেখে অটো নিয়ে চলে যান দুর্গাসাগর। সেখান থেকে বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে ফিরতে পারেন।

মাসুদ রানা মিঠু
লেখক: ফ্রিকোয়েন্ট ট্রাভেলার (পূর্বে প্রকাশিত এবং ঈষৎ সম্পাদিত)