মোহাম্মদ আব্দুল হালিম
বাংলাদেশের তিনটি পার্বত্য জেলার মধ্যে একটি বান্দরবান এবং এটি বাংলাদেশের সবচেয়ে কম জনবসতিসম্পন্ন স্থান। বাংলাদেশের সর্বোচ্চ পর্বতশৃঙ্গ সাকা হাফং (১০৫২ মিটার), দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম পর্বতশৃঙ্গ কেওক্রাডং (৮৮৩ মিটার) এবং সর্বোচ্চ খাল রাইখিয়াংসহ বিশালাকার ঝর্ণাগুলো এই জেলায় অবস্থিত। বাংলাদেশের ভেতরে, বান্দরবানকে দক্ষিণ-পশ্চিম অঞ্চল জুড়ে ঘিরে রয়েছে কক্সবাজার, উত্তর-পশ্চিমে চট্টগ্রাম, উত্তরে রাঙামাটি এবং পূর্বে মায়ানমারের চিন প্রদেশ এবং আরাকান প্রদেশের সীমান্ত। আজ তেমন কিছু ঝর্ণার পরিচিত করার লক্ষ্যে সামান্য চিত্র তুলে ধরব।
তিনাপ সাইতার
তিনাপ সাইতারকে বলা হয় ঝর্ণার রাজা। তিনাপ সাইতার হচ্ছে বাংলাদেশের বান্দরবান জেলার রোয়াংছড়িতে অবস্থিত একটি জলপ্রপাত। বম ভাষায় তিনাপ অর্থ নাকের সর্দি এবং সাইতার অর্থ ঝর্ণা বা জলপ্রপাত। রোয়াংছড়িতে হলেও রুমা উপজেলা দিয়ে এই ঝর্ণার কাছে যাওয়া অধিকতর সহজ। পানিপ্রবাহের দিক থেকে তিনাপ সাইতার বাংলাদেশের সব থেকে বড় জলপ্রপাত।
জাদিপাই ঝর্ণা
জাদিপাইকে বলা হয় ঝর্ণার রাণী। বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত বাংলাদেশের প্রশস্ততম ঝর্ণাগুলোর মাঝে এটি একটি। এজন্য বাংলাদেশের অন্যতম আকর্ষণীয় জলপ্রপাত হচ্ছে জাদিপাই। বর্ষাকালে জলপ্রপাতের পানি প্রবাহ বছরের অন্যান্য সময়ের তুলনায় বৃদ্ধি পাওয়ায় একে নায়াগ্রা জলপ্রপাতের মত মনে হয়। বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ র্চড়া কেওক্রাডং পাহাড় থেকে জাদিপাই ঝর্ণা পর্যন্ত প্রায় ৪৫ডিগ্রি কোনে পায়ে হেঁটে আসতে দুই ঘণ্টা সময় লাগে।
তলাবাং ঝর্ণা
রাজা রানী ত হলো, এবার আসা যাক ঝর্ণার রাজপুত্রকে নিয়ে। তলাবাং ঝর্ণাকে বলা যায় ঝর্ণার রাজপুত্র। ডাবল ফলস বা ত্লাবং ঝর্ণা, বান্দরবান জেলার রুমা উপজেলায় অবস্থিত। এটি দ্বৈত ঝর্ণা কিংবা জোড়া ঝর্ণা বা ক্লিবুং খাম নামেও পরিচিত। এই ঝর্ণা থেকেই পাথুরে রেমাক্রি খালের উৎপত্তি।
বাক্লাই
এটিকে বলা হয় ঝর্ণার রাজকন্যা, যা বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ঝর্ণা। এই ঝর্ণার উচ্চতা ৩৯০ ফুট এবং রুমার বাক্লাই গ্রামে এটি অবস্থিত। রুমাতে হলেও থানচি থেকে ৪৫কিমি দূরে এটি। প্রায় ৩৯০ ফুট উঁচু পাহাড়ের খাজ বেয়ে তীব্র জলধারা যখন পাথরে আছড়ে পড়ে তখন চারপাশের বুনো পরিবেশে এক অন্যরকম অনুভূতির জন্ম দেয়!
সাইংপ্রা
বান্দরবান আলীকদম এর গহীনে লুকিয়ের থাকা ঝর্ণাগুলোর মধ্যে এটি একটি। অনিন্দ্য সুন্দর সাইংপ্রা ঝর্ণার রয়েছে তিনটি ধাপ।
লাংলুক
মার্মা ভাষায় লাংলুক অর্থ বাদুড়। এটি লাংলুক ঝর্ণা নামেও পরিচিত। দিনদিন পর্যটকদের কাছে আকর্ষণীয় পর্যটনস্থানে পরিণত হচ্ছে লিলুক বা লাংলুক। গহীন অঞ্চলে হওয়ায় দীর্ঘদিন এটি পর্যটকদের নজরের বাইরে ছিলো। প্রায় ২৮০ ফুট উপর থেকে পাথরের দেয়াল বেয়ে এটি নেমে আসে যা দেখতে অন্যান্য ঝর্ণাগুলো থেকে আলাদা।
ক্রাইক্ষ্যং
বেশীরভাগ পর্যটকদের অপরিচিত ‘জিন্না পাড়া ক্রাইক্ষ্যং হ্লোম’ ঝর্ণা। এটি থানচিতে অবস্থিত। খাড়া দেবতা পাহাড় পাড় হয়ে চলে আসা যায় এই ঝর্ণায়। সহজ ট্রেইল ধরে জিন্না পাড়া থেকে মাত্র ৩০ মিনিট হাটলেই পড়বে এই দুর্গম ঝর্ণাটি।
জিন সিয়াম সাইতার
জিন সিয়াম ঝর্ণাটি রুমা থানার রুমানা পাড়ার পাশে অবস্থিত। এর তিনটি ধাপ রয়েছে। তবে রুমানা পাড়া থেকে গেলে প্রথম ও দ্বিতীয় ধাপ দেখে আসা যায় কিন্তু লুংথাউসিহ পাড়া দিয়ে গেলে সবগুলো ধাপ দেখে আসা যায়।
তারপি সাইতার
রুমা উপজেলাতে এই ঝর্ণার অবস্থান। লুং ফের ভা সাইতারে যাওয়ার পথেই এই দুর্গম ঝর্ণাটি দেখা যায়।
লুং ফের ভা সাইতার
বান্দরবানে অবস্থিত একটি বিশাল ঝর্ণার নাম। নাম যেমন কঠিন, এই ঝর্ণায় যাওয়ার ট্রেইলও তেমন কঠিন। এখন পর্যন্ত হাতে গোনা মাত্র কয়েকজন মানুষের পা পড়েছে এই ঝর্ণায়। এটি রুমা উপজেলায় অবস্থিত।
দামতুয়া ঝর্ণা
বান্দরবান জেলার আলিকদম উপজেলায় এই ঝর্ণাটি অবস্থিত। এই ঝর্ণাটি একাধিক নামে পরিচিত। ঝর্ণাটি মুরং এলাকায় অবস্থিত। এখানে দুইদিক থেকে পানি পড়ার কারনে ঝর্ণাসহ খোলা স্থানটিতে চাঁদের আলোতে অন্যরকম সৌন্দর্যের সৃষ্টি হয়, যে কারনে স্থানীয় মুরং ভাষায় ‘লামোনই’ ঝর্ণাও বলা হয়।
ওয়াং-পা
এই ঝর্ণাটি আলিকদমের গহীনে অবস্থিত একটি পাগল করা ঝর্ণা। দামাতুয়া ঝর্ণার কাছাকাছি এই ঝর্ণাটি অবস্থিত, যা অনেকটা আড়ালে বলা যায়! মেম্বার পাড়াতে ৮০ ডিগ্রী খাড়া পাথর বেয়ে এই ঝর্ণার কাছে যাওয়া যায়।
ফাইপি-ফাইপি ঝর্ণা
বান্দরবানের থাইকাং পাড়ায় অবস্থিত এটি। থানচি অথবা রুমা উপজেলা থেকে এখানে আসা যায়। ব্যোম ভাষায় ‘ফাইপি’ অর্থ ‘হাতির বাঁধা’। ঝর্ণার ঠিক নিচে রয়েছে বিশালাকার আধাআধি ডুবো পাথর।
নাফাখুম
নাফাখুম জলপ্রপাত বান্দরবান জেলায় অবস্থিত একটি প্রাকৃতিক জলপ্রপাত। নাফাখুম মারমা শব্দ। নাফা অর্থ ‘মাছ’ আর খুম অর্থ ‘জলপ্রপাত’। এটিকে আমিয়াখুম জলপ্রপাতের পরই বাংলাদেশের দ্বিতীয় বড় জলপ্রপাত হিসেবে ধরা হয়। অনিন্দ্য সুন্দর এই জলপ্রপাতটি রেমাক্রি থেকে মাত্র আড়াই ঘণ্টা হাঁটার পথ দূরত্বে অবস্থিত।
আমিয়াখুম
পাহাড়ি সাঙ্গু নদী তীর বয়ে চলার পথে অজস্রস্থানে ছোটছোট জলপ্রাপাতের সৃষ্টি করেছে, তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে আমিয়াখুম। খুম মানে হচ্ছে যেখানে পানি কখনো একেবারে শুকায় না। ঝর্ণার পানি শুকাবে কিন্তু খুমের না। এটি অসাধারণ একটি জলপ্রপাত বা ঝর্ণা।
রিঝুক ঝর্ণা
রুমা উপজেলার এই ঝর্ণার পানি প্রায় ৩০০ ফুট উঁচু থেকে চমৎকার শব্দ করে সারাবছর সাঙ্গু নদীতে পড়ে থাকে। রিজুক ঝর্ণার পানি মুক্তার মত চকচকে যা প্রকৃতির সৌন্দর্যের এক অনন্য নিদর্শন।
শীলবাঁধা ঝর্ণা
এই ঝর্ণাটি রোয়াংছড়ি উপজেলার কচ্ছপতলি ইউনিয়নে অবস্থিত। শীলবাধা পাড়াতে অবস্থিত বলে পাড়ার নাম অনুযায়ী এর নামকরণ। এই পাড়া থেকে তারাছা খাল ধরে মাত্র ১৫ মিনিট হেটে গেলেই পড়বে দেবতাখুম।
থানকোয়াইন ঝর্ণা
আলিকদমে অবস্থিত এই ঝর্নাটি থানকোয়াইন ঝিরি থেকে উৎপত্তি। দুছড়ি বাজার থেকেই ট্রেকিং করে যেতে হয়। এই ঝর্ণা দেখার পথে মিলবে পালংখিয়াং, জামরুম ল্যাদমেরাগ ও ক্র্যাতং ঝর্ণা। রেম্বক পাড়া থেকে এই ঝর্ণাগুলো দেখার সুবিধা বেশি।
রিসংসং ঝর্ণা
এই ঝর্ণাটি রুমা উপজেলার মুরংবাজার থেকে ১ ঘন্টার সহজ ট্রেইল ধরে যাওয়া যায়। প্রায় ১১০ ফুট থেকে এর জলধারা পাথরে এসে পড়ে।
তাংমাইন ঝিড়ি ঝর্ণা, পালঙকিয়ং ঝর্ণা এবং লাদ মেরাখ
এই ঝর্ণাগুলো আলীকদম উপজেলার কুরুকপাতা ইউনিয়নের। মূলত তৈনখালে এই তিনটি ঝর্ণা। আমতলী লংঘাট নামক স্থান থেকে ইঞ্জিনচালিত বোট দিয়ে দেড় ঘন্টা গেলে দুছড়ি বাজার। দুছড়ি বাজার থেকে নদী পথে তাংমাইন ঝর্ণা, এরপর পালংখিয়ং এবং লাদ মেরাখ।
চিংড়ি ঝর্ণা
বগালেক থেকে কেওক্রাডং এর পথে ঘণ্টাখানেকের পাহাড়ি পথ হাটলে চিংড়ি ঝর্ণাধারা দেখা যায়। মূল ঝর্ণা দেখতে হলে বিশালাকারে পিচ্ছিল পাথরগুলো পার হয়ে ডান দিকে ৯০ ডিগ্রি ঘুরে যেতে হয়।
তিনাম ঝর্ণা
আলিকদম উপজেলার প্রকৃতির এক বিস্ময় হল এই ঝর্ণা। সুউচ্চ পাহাড় থেকে খানিক দূরত্বে পাশাপাশি দুইটি ঝর্ণা অবিরামধারায় ঝরছে অবিরত।
উপরের ঝর্ণাগুলো ছাড়াও আরো প্রায় অর্ধশতাধিক ঝর্ণা রয়েছে। প্রতিবছর ট্রেকারদের মাধ্যমে নতুন নতুন ঝর্ণা আবিষ্কার হয়, ট্যুরিস্ট পুলিশ তাদের নিরাপত্তা সহায়তা প্রদানে সদা তৎপর।
লেখক: পুলিশ সুপার, ট্যুরিস্ট পুলিশ, বান্দরবান রিজিয়ন