/প্রবাসজীবন

প্রবাসজীবন

প্রবাসে বাংলাদেশি নতুন প্রজন্ম 

ছেলেরা ছেলে বিয়ে করছে, ধর্মান্তরের কথা ভাবছে! 

নিয়াজ মাখদুম 

আমেরিকায় সন্তানরা বাবা-মায়েদের চক্ষুশীতলকারী হিসেবে গড়ে উঠছে নাকি তারা এক একটি বিষবৃক্ষ হিসেবে জন্ম নিচ্ছে তারা কি পিতা-মাতাদের আশীর্বাদ না অভিশাপ? তা নিয়ে কমিউনিটিতে রয়েছে নীরব প্রশ্ন। বিশেষ করে বাংলাদেশ থেকে আসা মানুষদের অধিকাংশই তাদের সন্তানদের নিয়ে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত। কিভাবে সন্তানদের সুশিক্ষায় শিক্ষিত করা যায়, আচার-ব্যবহারে, উত্তম চরিত্র গঠনে, ধর্ম চর্চায় সুন্দর মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা যায় তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী পিতা-মাতারা হন্যে হয়ে সঠিক পথ খুঁজছেন। কেউ কেউ সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে পারলেও অধিকাংশের ক্ষেত্রে রয়েছে হতাশার দীর্ঘশ্বাস। 

নিউইয়র্কে বসবাসকারী একজন বাংলাদেশি বাবা স্থানীয় এক সংবাদপত্র অফিসে তার বাড়ি ভাড়ার বিজ্ঞাপন দিতে এসে আলাপচারিতায় প্রবাস জীবনের পাওয়া না-পাওয়া নিয়ে কথা তুললেন। বাড়ি-গাড়ি, আর্থিক সাফল্য এসেছে তার জীবনে, কিন্তু সন্তান-সন্ততি নিয়ে তার বুকের ভেতর রয়েছে ভীষণ জ্বালা। আলাপচারিতার মাঝে হঠাৎ থেমে গিয়ে এক দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘জানেন, সবসময় আল্লাহর কাছে একটি দোয়া করি।’ কথাটি বলে ভদ্রলোক থেমে গেলেন। উপস্থিত একজন প্রশ্ন করলেন, কী দোয়া করেন ভাই? লোকটি আবার দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন, ‘সবসময় আল্লাহকে বলি, আমার সামনেই যেন আল্লাহ আমার বড় ছেলেটির মৃত্যু হয়।’ একজন বাবার এমন কামনা শুনে আড্ডার পরিবেশ ভারি হয়ে ওঠে। ওই বাবা তার ছেলের অমানুষ হওয়ার কয়েকটি ঘটনা বললেন সেখানে।

আরেকজন প্রবাসী বাবা নিজের ছেলের বিয়ে নিয়ে দুঃখভরা মনে বললেন, আমরা আমাদের কোনো বংশধরদের এ দেশে রেখে যাচ্ছি! নিজের সন্তানের বিয়ের কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ছেলে আমার হঠাৎ একদিন ফোনে জানালো বাবা বিয়ে করেছি। আমি মনে কষ্ট পেলেও ভাবলাম আমেরিকান সমাজে তো অনেকে বিয়েই কওে না, তবু তো আমার ছেলে অন্তত বিয়ে করেছে।’ তিনি বাংলাদেশি কালচার, মুসলমানদের ইসলামী রীতিনীতি এবং পারিবারিক ঐতিহ্য সব কিছুর কথা ভুলে গিয়ে বললেন, ‘বাবা এ তো সুখবর! তোমার বউকে নিয়ে বাসায় আসো। আমাদের সঙ্গে অন্তত পরিচয় করিয়ে দাও।’ ফোবানার ওই কর্মকর্তা মুখ মলিন অবস্থায় জানালেন, ‘বাসার কলিংবেল বাজলে দারজা খুলে দেখি আমার ছেলের সঙ্গে আরেকটি ছেলে। আমার ছেলে জানালো ওই ছেলেটিই নাকি ওর বউ! তাকেই আমার ছেলে বিয়ে করেছে …।’

নিউইয়র্ক লংআইল্যান্ডে বহু বছর ধরে বসবাস করছেন এক বাংলাদেশি অভিবাসী পরিবার। ভদ্রলোকের স্ত্রী এখন বয়সভারে ক্লান্ত। সন্তানদের প্রসঙ্গে কথা বলতে গিয়ে বললেন, ‘ভাই এ দুঃখ কোথায় রাখি, কিভাবে নিজেকে সান্ত¡না দেবো, জানি না। নিজেদের জীবনের সব সুখ বিসর্জন দিয়ে ছেলেমেয়েদের বড় করেছি। এখন তারা নিজের পায়ে দাঁড়াতে শিখেছে, কিন্তু যখনই তাদের নিজেদের স্বার্থের ব্যাপার আসে তখন বলে তোমরা বাংলাদেশি বাবা-মা, আমাদের জন্য তো তোমরা করেই যাবে। আর যখন আমরা আমাদের কোনো প্রয়োজনের কথা বলি, তখন তারা বলে, তোমাদের জানা প্রয়োজন এটা বাংলাদেশ নয়, বাংলাদেশের কালচার এখানে প্রয়োগ করার চিন্তা করো না। আমরা আমেরিকান। তোমাদের প্রয়োজন তোমাদেরই মেটাতে হবে …।’

আরেকজন মা তার মেয়ের অনুভ‚তি নিয়ে ভীষণ বেকায়দায় পড়েছেন। সঠিক উত্তর নিজের কাছে নেই বলে এক আলোচনায় মেয়ে নিয়ে কথা তুললেন। ভদ্র মহিলার মেয়ে সিক্স গ্রেডে পড়ে। মেয়ে মাকে তার অনুভ‚তির কথা বলতে গিয়ে বলল. মা তোমরা মুসলমান হলেও আমি যখন বড় হবো, তখন আমি খ্রীষ্টান হয়ে যাব। মা চমকে উঠে জানতে চাইলেন, ‘কেন মা, তুমি এমন কথা কেন বলছো?’ উত্তরে মেয়ে বলল, ‘তোমাদের ইসলাম ধর্মে কোনো ফান নেই, মাত্র দুটি ঈদে কিছু ফান হয়; তাও আবার আমার মুসলিম ফ্রেন্ডরা একদিনে ঈদ করতে পারে না। প্যারেন্টরা ভিন্ন ভিন্ন দিনে ঈদ করে। এত কম ফান আর ঝামেলার চেয়ে কি খ্রীষ্টান হয়ে যাওয়া অনেক ভালো না, মা? খ্রীষ্টানরা সারা বছরই কোন  না কোন ফান করছে!’ ভদ্র মহিলার প্রশ্নÑ ‘আমার মেয়েকে কি উত্তর দিব?’

বাংলাদেশি কমিউনিটির সব সন্তান যে বখে যাচ্ছে কিংবা অমানুষ হচ্ছে অথবা মুসলিম সন্তানরা অন্য ধর্মাবলম্বী হওয়ার কথা চিন্তা করছে, তা নয়। তবে কী কারণে সন্তানরা সুনাগরিক হচ্ছে কিংবা হচ্ছে না, তা নিয়ে সঠিক পথ-পন্থা সুস্পষ্ট নয় আমেরিকায় বসবাসকারী অনেক বাবা-মায়েদের কাছে। এ নিয়ে বিজ্ঞজন এবং সফল পরিবারের মুখোমুখি হই আমরা।

ল’ ফার্ম অব নাজমুল আলম এলএলসির কর্ণধার এবং পরিচালক অ্যাটর্নি নাজমুল আলম। যুক্তরাষ্ট্রে আইন পেশায় দীর্ঘ অভিজ্ঞতাসহ আইনি সহায়তা দিয়ে আসছেন অনেকদিন। আমেরিকানদের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের অভিবাসী, বিশেষ করে বাংলাদেশি কমিউনিটির আইন-সংক্রান্ত সমস্যার ক্ষেত্রে প্রফেশনালি সহযোগিতা করছেন তিনি। দুই যুগের বেশি সময় ধরে বাংলাদেশি পরিবার, তাদের সন্তান-সন্ততি, পারিবারিক সমস্যা এবং এ দেশের আইনি বিষয়াদি নিয়ে নাজমুল আলমের রয়েছে বাস্তব অভিজ্ঞতা। সেই বাস্তবতার নিরিখে পরামর্শ দিলেন তিনি।

আমেরিকান সমাজে কোনো সন্তান ‘বিষবৃক্ষ’ হয়ে জন্ম নিক কিংবা সমাজের জন্য একটি অনাকাক্সিক্ষত, অপ্রত্যাশিত অমানুষ হিসেবে বেড়ে উঠুক তা কোনো মা-বাবাই চান না। কিন্তু বাস্তবে সে রকমটিই লক্ষ্য করা যায় অনেক পরিবারের ক্ষেত্রে। এক্ষেত্রে অ্যাটর্নি নাজমুল আলম বলেন, আমরা আমেরিকায় আসতে পেরেছি, এখানে সুখে-শান্তিতে বসবাস করার সুযোগ পেয়েছি এবং এ দেশের প্রায় সব সুবিধা আমরা ভোগ করছি; এগুলো আমাদের জন্য অনেক বড় পাওয়া। প্রথমত, বাংলাদেশ থেকে আসা বাবা-মায়েদের আমেরিকা সম্পর্কে জানতে হবে। আমেরিকার আইন-কানুন, সামজচিত্র, কালচার ইত্যাদি বিষয়ে তাদের সঠিক জ্ঞানার্জন প্রয়োজন। বাংলাদেশি পিতা-মাতাদের মনে রাখতে হবে, কাউকে শিক্ষা দেয়ার আগে নিজে শিক্ষা নেয়া উচিত। আমেরিকান সমাজে বাংলাদেশি পরিবারের সন্তানদের ‘চক্ষুশীতলকারী’ হিসেবে সুশিক্ষিত, ধার্মিক এবং ভালো মানুষ হিসেবে গড়ে তোলা বাংলাদেশ থেকে আসা বাবা-মায়েদের জন্য বেশ কঠিন। কেননা, বাংলাদেশি বাবা-মায়েরা বাংলাদেশের কালচারে বড় হয়েছেন। বাংলাদেশের পারিবারিক শিক্ষা, সামাজিক শিক্ষা, ধর্মীয় শিক্ষা আমেরিকান সমাজের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে সামঞ্জস্যপূর্ণ নয়; তাই বাবা-মায়েরা নিজেদের সন্তানদের শিক্ষা দিতে গিয়ে অনেক সময় আমেরিকান আইন লঙ্ঘন করছেন। তাদের শিক্ষাদানের প্রক্রিয়ায় ভুল থাকার কারণে পরিবারে অশান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। সন্তানরা বাবা-মায়ের অবাধ্য হচ্ছে এবং এ দেশের আইনি বেড়াজালে আটকে পড়ছে অনেকেই। এক্ষেত্রে করণীয় হলো, বাবা-মায়েদের টলারেন্স থাকতে হবে। বাচ্চাকে মারধর করা, গায়ে হাত দেয়া কিংবা ক্রুয়েল পানিশমেন্ট দেয়া বাংলাদেশে পরিবারের স্বাভাবিক চিত্র হলেও যুক্তরাষ্ট্রে তা দÐনীয় অপরাধ। এ বিষয়ে বেখেয়াল হওয়ায় অনেক ভোগান্তিতে পড়তে হয় পরিবারের অভিভাবকদের। পিতা-মাতার পারিবারিক অনুশাসন অনেক সময় আইনি লড়াইয়ে পরিণত হয়। 

প্রসঙ্গত নাজমুল আলম বলেন, প্রতিটি বাংলাদেশি বাবা-মায়েদের মনে রাখা প্রয়োজন আমরা অন্য দেশে আছি। এখানকার এনভার্মেন্ট বাংলাদেশ থেকে ভিন্ন। এ দেশে সন্তানদের বিরুদ্ধে না গিয়ে কিভাবে তাদের সংযুক্ত করা যায় সে পন্থা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আইসুলেশনের পরিবর্তে সলিউশনের চেষ্টা করা উচিত। প্যারেন্টিংয়ের জন্য প্রাথমিক শিক্ষাগার হচ্ছে ঘর। ঘর থেকেই সন্তানের ফাউন্ডেশন তৈরি করতে হবে। তা শৈশবকাল থেকেই শুরু হওয়া প্রয়োজন। ছোটবেলা থেকে সন্তানকে হালাল খাবার খাওয়ানো এবং ইসলামের শিক্ষা দেয়া মুসলিম পরিবারের একান্ত কর্তব্য। সন্তানদের শিক্ষা দিতে গিয়ে বাবা-মাকেও সে প্র্যাকটিস করতে হবে। মনে রাখতে হবে, সন্তানরা শুধু বাবা-মায়ের মুখের কথাই শুনে না, তারা পিতা-মাতার চালচলনও শিখে থাকে একই সঙ্গে। 

যারা বাংলাদেশ থেকে সিক্স, সেভেন, এইট গ্রেড পড়ে এসেছে এমন সন্তানদের সম্পর্কে জনাব নাজমুল আলম বলেন, এসব সন্তান এ দেশে আসার পরপর যদি বাবা-মায়েরা তাদের সম্পর্কে প্রথম থেকেই সতর্ক না থাকেন, তবে খুব তাড়াতাড়ি তারা এখানকার খারাপ বিষয়গুলোকে এডপ করে। প্রথম পর্যায়ে সতর্ক না হওয়ার কারণে যখন সন্তানের মাঝে খারাপ বিষয়গুলো এসে যায়, তখন পিতা-মাতা তাদের সঙ্গে বন্ধুত্বসুলভ আচরণ না করে বাংলাদেশের স্টাইলে শাসন শুরু করেন, যা হিতে বিপরীত হয়। এক্ষেত্রে সন্তানদের এখানকার সোসাইটি সম্পর্কে  বোঝাতে হবে। বাচ্চাদের কমপেয়ারিজম শিখাতে হবে। তাদের সামনে দুটি সাইডই তুলে ধরতে হবে। জাজমেন্ট ছাড়তে হবে সন্তানদের ওপর। সন্তানদের রেফারেন্স টেনে কথা বলতে হবে। শুধু একটি সাইড বললে এখানকার সন্তানরা তা মেনে নিতে চায় না। ব্যাখ্যা ছাড়া সন্তানদের ওপর প্রেসার ক্রিয়েট করলে হিতে বিপরীত হয় অধিকাংশ ক্ষেত্রে। 

মেরিল্যান্ডে বাংলাদেশি অভিবাসী ‘খান’ পরিবারের বসবাস দীর্ঘ ৩২ বছর ধরে। খান পরিবারে জন্ম নেয়া তিন সন্তানÑ দুই মেয়ে এবং এক ছেলে সবাই নিজ নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং স্থানীয়ভাবে মানুষের সেবায় বিভিন্নভাবে সম্পৃক্ত। এ পরিবার সম্পর্কে জানেন এমন ব্যক্তিরা ‘খান পরিবার’কে একটি আদর্শ সফল পরিবার বলে মনে করেন। খান পরিবারের বড় মেয়ে ফারিহা খান স্কুল শিক্ষিকা। ইউনিভার্সিটি অব ম্যারিল্যান্ড কলেজ পার্ক থেকে ব্যাচেলর এবং মাস্টার্স ডিগ্রি অর্জন করেছেন। দ্বিতীয় মেয়ে ফাসিহা খান ইউনিভার্সিটি অব বাল্টিমোর, ল’ ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে বর্তমানে কানাডায় বসবাস করছেন। ছোট ছেলে জাবির খান কম্পিউটার সায়েন্স বিষয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করে বর্তমানে মেরিল্যান্ডে আইটি ফিল্ডে কর্মরত। 

এ সন্তানদের প্রতি বাবা ফরহাদ খানের সার্বিক পর্যবেক্ষণ এবং তত্তাবধান থাকলেও যিনি তিলে তিলে তাদের গড়ে তুলেছেন এবং বর্তমানে তাদের সন্তানদের অর্থাৎ, নাতি-নাতনিদের লালন-পালনে সহায়তা করছেন তিনি হলেন তিন সন্তানের মা হুমায়রা খান। আমরা তাঁর মুখোমুখি হই বিষয়টি নিয়ে।

এ দেশে বাংলাদেশি কমিউনিটির সন্তানরা বখে যাচ্ছে। আমেরিকান সমাজে তাদের পরিবারের মুখ উজ্জ্বল করা ‘চক্ষুশীতলকারী’ হিসেবে মানুষ করা প্রায় অসম্ভব। এখানকার রীতিনীতি, কালচার, সমাজচিত্র বাংলাদেশ থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন হওয়ায় বাংলাদেশি বাবা-মায়েরা তাদের জেনারেশন হারাতে বসেছেন এমন অভিযোগ অনেকের। আপনি বিষয়টিকে কিভাবে দেখেন?

এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিলিভার বা একজন বিশ্বাসী মানুষ হিসেবে সবসময় আমাদের আল্লাহর ওপর তাওয়াক্কুল করতে হবে। তাছাড়া মনে রাখতে হবে, ‘ইউর হোম ইজ বেস্ট লার্নিং প্লেস।’ অর্থাৎ, আপনার ঘর হলো শ্রেষ্ঠ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। জন্ম থেকেই সে শিক্ষা শুরু হয় এবং তা কখনো শেষ হয় না। তাছাড়া মা হলেন সন্তানের প্রথম টিচার। বাবা পরিবারের আর্নিং মেম্বার আর মা হলো সন্তান তৈরির কারিগর। তাই এ দেশে প্রথমে মাকে শিখতে হবে, জানতে হবে। আর সে জানা যদি কোরআন-হাদিস থেকে নেয়া যায় তা হবে শ্রেষ্ঠ পন্থা। 

হুমায়রা খান বলেন, ইসলাম যেহেতু ‘কমপ্লিট কোড অব লাইফ’ অর্থাৎ পূর্ণাঙ্গ জীবন বিধান; তাই সন্তানকে কিভাবে, সঠিক পন্থায় মানুষ করা যাবে। কী শিক্ষা দান করলে তারা চক্ষুশীতলকারী হিসেবে সমাজে বেড়ে উঠবে তা অবশ্যই কোরআন-হাদিসে রয়েছে। আমাদের শুধু জেনে নিতে হবে। তিনি বলেন, কোরআন-হাদিসের শিক্ষার পাশাপাশি বাবা-মায়েরা যদি পারেন ‘হাউ টু রেইজ চিলড্রেন ইন ওয়েস্টার্ন সোসাইটি’ অর্থাৎ, পাশ্চাত্যে শিশু লালন-পালনের পদ্ধতি কী হবে এ বিষয়ে অনলাইনে এবং লাইব্রেরিতে অনেক বই এবং সাজেশনধর্মী ইনফরমেশন রয়েছে তা থেকে সাহায্য নেয়া যেতে পারে। 

বাংলাদেশের কালচার, চিন্তা, ভেলু এখানে আশা করা ঠিক নয় উল্লেখ করে হুমায়রা খান বলেন, আমরা যারা বাচ্চাদের এদেশে এনেছি, তাদের চয়েস ছিল। কিন্তু এখানে আনার পর বাংলাদেশের কালচারটা তাদের ওপর চাপানো ঠিক হবে না। তিনি বলেন, আমরা যেমন বাংলাদেশে বড় হয়েছি বাংলাদেশের কালচারকে এডপ করে, এখানকার বাচ্চারাও এ দেশে বড় হচ্ছে এখানকার কালচারকে এডপ করে। তবে বাসায় যদি আমরা তাদের মূল্যবোধ শেখাই এবং সে শিক্ষাদানের ধারাবাহিকতা রাখতে পারি, তবে অবশ্যই ভালো ফল আশা করা যায়। 

হুমায়রা খান বাসার শিক্ষা দানের সঙ্গে সঙ্গে ফ্রেন্ড সার্কেল এবং সামাজিক সম্পৃক্ততা নিয়ে বলেন, আমেরিকা ইসলামিক সংগঠন মুনা, লিমা, এমএসএসহ অন্যান্য ইসলামিক অর্গানাইজেশন এবং স্থানীয় মসজিদ ও ইসলামিক সেন্টারের সঙ্গে ধারাবাহিক কানেকশন থাকা জরুরি। বাচ্চারা ইনফ্লুয়েন্সটা যেন ভালো গ্রুপ থেকে পায়। মনে রাখা জরুরি, ‘গুড স্টুডেন্ট মিনস গুড ক্যারিয়ার’। তিনি বলেন, কোনো বাচ্চার মাঝে খারাপ কোনো বিষয় এসে গেলে তাকে পরিবর্তনের জন্য শুধু লেকচার দেয়া কিংবা ধমকানো বা প্রেসার ক্রিয়েট করা কোনো সমাধান নয়। বাচ্চার ব্যাড ইনফ্লুয়েন্স ইরেস করতে হলে ধারাবাহিকভাবে ‘ভালো’ দিয়ে তার পরিবর্তন আনতে হবে। 

পাবলিক স্কুল প্রসঙ্গে হুমায়রা খান বলেন, সপ্তাহের ৫ দিন ৮ ঘণ্টা করে মোট ৪০ ঘণ্টার একটা বিরাট ইফেক্ট আছে। তাই পাবলিক স্কুলের খারাপ বিষয়গুলো যেন বাচ্চার ক্যারেক্টারের মধ্যে না আসতে পারে সে জন্য তাদের সঙ্গে ওপেন কমিউনিকেশন জরুরি। বাবা-মা কিংবা বাসার বড়রা বাচ্চার বন্ধু হতে হবে। প্রতিদিন অনন্ত এক বেলা সবাই মিলে একসঙ্গে লা  কিংবা ডিনার করা এবং সেখানে তাদের সঙ্গে প্রাসঙ্গিক বিষয়গুলো শেয়ার করা। বাচ্চাদের কোনো ভুল ধরা পড়লে তা নিয়ে রাগারাগি না করে বন্ধুসুলভ আচরণের দ্বারা বুঝিয়ে তাদের ওই ভুল থেকে ফেরানোর চেষ্টা করা। এক্ষেত্রে ফ্রেন্ডলি রিলেশন রাখা জরুরি। 

যে পরিবারে সম্ভব সিক্স-সেভেল গ্রেড পর্যন্ত বাচ্চাদের ডে-কেয়ারে না দিয়ে মায়েদের কাছে রাখা। ভালো ফল পেতে হলে বাচ্চাদের মায়ের সময় দিতেই হবে। ‘মোর স্পেন্ড ইউর টাইম, ইউ উইল গেট বেস্ট রেজাল্ট’। অর্থাৎ, অধিক সময় ব্যয় করলে শ্রেষ্ঠ ফল লাভ করা যাবে। এর ফলে মায়ের সঙ্গে বাচ্চার ফ্রেন্ডশিপ বৃদ্ধি পায়। হুমায়রা খান প্রসঙ্গত বলেন, আমরা সুন্নাহ থেকে পাই

* ৫ বছর পর্যন্ত পেসেন্স মায়া দিয়ে বন্ধুত্ব তৈরি করা। 

* ৬-৮ বছর ডিসিপ্লিন শেখানো। ঠিকমতো লেখাপড়া, আদব-কায়দা, নামাজ, চরিত্র গঠনে শিক্ষা দান ইত্যাদি।

* ৯-টিন পর্যন্ত মাকে বাচ্চার ফ্রেন্ড হতে হবে। ‘নো মেটার হোয়াট’। বাচ্চা যা পছন্দ করে তার সঙ্গে পার্টিসিপেট করতে হবে। লাইফে যে আনন্দ আছে তা বাচ্চাকে বোঝাতে হবে। এ বয়সে যখনই সময় পাওয়া যায়, এক সঙ্গে সময় কাটানো। বাবা-মাকে বুঝতে হবে, বাংলাদেশের সোসাইটি আর আমেরিকান সোসাইটি এক নয়। বাচ্চার ওপেনিয়ন গ্রো করে ১০ টু টিন এজে। ভালো গ্রুপের সঙ্গে সর্বদা উঠাবসা করা এবং আল্লাহর কাছে দোয়া করা জরুরি। রেগুলার গার্লস এবং বয়েস স্কাউটও করা যেতে পারে। 

হুমায়রা খান খুব গুরুত্বের সঙ্গে বলেন, এ বয়সে বাচ্চাদের কখনও ফ্রি টাইম দিতে নেই। তাদের সারাক্ষণ বিজি রাখতে হবে। সপ্তাহে ৫ দিন স্কুলের পর আফটার স্কুল যত প্রোগ্রামে ব্যস্ত রাখা যায় তা পরিবারের পক্ষ থেকে আগে থেকেই প্রস্তুতি থাকতে হবে। উইকেন্ডেতে বয়েস স্কাউট, গার্লস স্কাউট, ভলান্টিয়ার করা, স্যুপ কিচেন, ফিজিক্যাল স্পোর্টসে দিলে ভালো। ইসলামিক সংগঠনের প্রোগ্রামগুলো বাচ্চাদের অফ টাইমে রাখা জরুরি। 

তিনি বলেন, ৫-৮ বছর পর্যন্ত ছোট বাচ্চাদের টিভি, ইন্টারনেট, গেইম থেকে যতদূর সম্ভব দূরে রাখা উত্তম। যদি কোনো পরিবারের মা ফুলটাইম কাজ করেন, সেক্ষেত্রে বাচ্চার জন্য বিভিন্ন কোর্সে সম্পৃক্ত করা, আফটার স্কুল প্রোগ্রামে দেয়া এবং দ্বীনি পরিবার ও ইসলামিক সংগঠনগুলোর প্রোগ্রামে অংশগ্রহণের ব্যবস্থা করা জরুরি।

* টিন থেকে ফিফটিনে উঠলেই কাজে পাঠাতে সন্তানকে উদ্বুদ্ধ করা। এর ফলে সন্তান যেমন দায়িত্বশীল হয়, তেমনি অর্থের ভেল্যু বুঝতে শিখে। বাবা-মাকে সবসময় সন্তানের জন্য আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে হবে; এখানকার সমাজের বাস্তব চিত্র সম্পর্কে জানতে হবে; নিজেদের মন থেকে শুধু বাংলাদেশি কালচার ধরে রাখার মানসিকতা পরিবর্তন করতে হবে। বাচ্চাদের বন্ধু হতে হবে এবং তাদের জন্য অন্তত মাকে সময় দিতে হবে। তবেই সন্তান বাবা-মায়ের চক্ষুশীতলকারী হিসেবে পাওয়ার আশা করা যায়। (আলাপন থেকে)

লেখক : যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী