মাহবুব আলম
বোখারা-সমরখন্দ-মারভ, যা তুরান এলাকা হিসাবে পরিচিত, এই অ ল ঘুরে দেখা লোভ আমার দীর্ঘদিনের। ইসলাম ধর্মের দ্বিতীয় জাগরণ হয় এই অ লে। এখানকার দুই পবিত্র আত্মা রসুল স.কে ধারন করেছেন ভালবাসায়, অনুসরণে, অনুকরণে এবং জীবনযাপনে। একজন রসুল স. এর পর্দার পর তাঁর সুরত বা শারীরিক কার্যাবলী ধরে রেখেছেন, আজীবন অক্লান্ত পরিশ্রমে। তিনি মোহাম্মদ ইবনে ইসমাইল বোখারী র.। হাদিস সংগ্রাহক হিসাবেই তিনি অতি পরিচিত। তাঁর অমর সংগ্রহগ্রন্থ ‘বোখারী শরীফ’। দ্বিতীয় পবিত্র আত্মা রসুল স. এর হাকিকত তথা আধ্যাত্মিক অবস্থান, অবস্থা ও কার্যাবলী ধরে রেখেছেন তাঁর বিশুদ্ধ আকায়েদ (ইসলাম বিশ্বাসগত ধারনা), আমল ও জীবন পরিচালন দিয়ে। তাঁর পবিত্র অনুসারীদের মাধ্যমে আজও পাওয়া যায় সেই পবিত্র আদি ও অন্তহীন সত্তার সান্নিধ্যের স্বাদ। তিনি হলেন ইমাম বাহাউদ্দিন নকশবন্দ বোখারী র.।
ইচ্ছা ছিল বোখারা-সমরখন্দ সফর করবো, প্রাণপ্রিয় মোর্শেদের সংগী হয়ে। ১৯৯৮ এবং ২০১২ সালে এই সফরের জন্য দুইদফা চেষ্টা করি। নানা কারনে তা সফল হয়নি। ২০১৩ সালে সুযোগ আসে আবার।
উজবেকিস্তানের বোখারা অ লের রাজধানি হচ্ছে বোখারা। এটি দেশের প ম বৃহত্তম শহর। ব্যবসা-বানিজ্য, শিক্ষা-সংস্কৃতি ও ধর্মীয় উৎকর্ষের জন্য দির্ঘকাল থেকে এই শহরের সুনাম রয়েছে। এই শহরের মসজিদ ও মাদরাসার অনেকগুলোই বোখারার ঐতিহাসিক স্থাপনা হিসাবে জাতিসংঘের অঙ্গপ্রতিষ্ঠান ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত।
বাংলাদেশ থেকে বোখারা যাওয়ার মূল সমস্যা হচ্ছে ভিসা। ঢাকাতে উজবেক এ্যামবাসি নেই। প্লেনের টিকেটও একটি সমস্যা। তখনও টিকেটের জন্য দিল্লী পর্যন্ত যেতে হতো, টিকেট কিনতে হতো নগদ রূপী দিয়ে। উজবেকিস্থানের প্রচলিত টুর প্যাকেজ-এ নানারকম নিয়ম কানুনের সীমাবদ্ধতা আছে। প্রচলিত টুর প্যাকেজ অনুসারে এই সফর হবে না, কেননা এই টুর প্রোগ্রাম আমাদের নিজস্ব তৈরি। তিন চারটা টুর অপারেটর পরিবর্তন করে এবং দুইমাস খাটাখাটনি শেষে পি ডাবিøউ ডি’র এক্স ইএন কচি ভাই এর সহযোগিতায় কাজটা হল। তার বিসিএস কোর্সমেট ওয়াহিদুজ্জামান ভাই উজবেস্তিানে বাংলাদেশ এম্ব্যাসিতে থার্ড সেক্রেটারি হিসাবে কর্মরত ছিলেন। তিনি টুর গাইড ঠিক করার ব্যাপারে সাহায্য করলেন। ২০১৩ সালের ২৯ শে মার্চ আমাদের যাওয়ার তারিখ স্থির হল। দশ দিনের সফর। ৯ ই এপ্রিল ২০১৩ ফেরার তারিখ।
ঢাকা থেকে যাবো সতির্থ আমরা ২৮ জন। ইংল্যান্ড, আমেরিকা, ইটালি, কম্বডিয়া ও অস্ট্রেলিয়া থেকে আসবেন বাকি ৭ জন। সাথে আমাদের সফরের মধ্যমণি সন্মানিত পীরমোর্শেদ। সবমিলিয়ে ৩৬ জনের দল।
উজবেকিস্তানে আমাদের মুল গন্থব্য বারোটি মাজার। হজরত খালেক গজদেওয়ানী র., হজরত আরিফ রেওগাড়ী র., হজরত মাহমুদ আঞ্জির ফাগ্নাবী র.,হজরত আজিজানে আলী রামেতিনি র., হজরত খাজাবাবা সাম্মাসী র., হজরত আমির কুলাল র., হজরত বাহাউদ্দিন নকশবন্দ র., হজরত ওবায়দুল্লাহ আহরার র.,হজরত ইমাম বোখারী র., হজরত ইমাম মাতুরিদী র., হজরত দরবেশ মোহাম্মাদ র., হজরত খাজেগী আমকাংগী র.। ইসলামের বাহ্যিক ও অভ্যন্তরিন বিশুদ্ধতা চর্চার ক্ষেত্রে তাদের অবদান অনস্বীকার্য, অপ্রতিস্থাপনীয়।
২৯ মার্চ সকালে এয়ার ইন্ডিয়ার প্লেনে চড়লাম, গন্থব্য দিল্লী। দিল্লিতে ১৪ ঘন্টার ট্রানজিট। জোহরের নামাজের পর সঙ্গী মান্নানভাই তাঁর ব্যাগ থেকে পরোটা আর মুরগী তরকারীর ডিব্বা বের করলেন। ভালো ভাবেই খাওয়া হলো। এরপর মিষ্টি আর পায়েস বের করলেন। মিষ্টি পায়েস শেষ হলে বললাম, আর কিছু নেই। উনি অপরাধীর মত চেহারা করে উত্তর দিলেন, না ভাই।
নামাজের ঘরের কাছে লাউঞ্জের একপাশে চাদর বিছিয়ে বসে শুয়ে আমরা সময় কাটাচ্ছি। কিছু আড্ডা, গল্প, জল্পনা কল্পনা, খানিক ঘুম এভাবে টাইম কেটে গেল। রাতের খাওয়া সারলাম এয়ারপোর্টেও হোটেলে। ভাত, সব্জিতরকারী, স্যুপ, মাছ, পাপড়, সালাদ, সবশেষে আইসক্রিম। বান্না ভালো। খাওয়ার মাঝামাঝি সময়ে দেখা গেল ভাত শেষ আর রুটির স্তূপ প্রায় অক্ষত অবস্থায় আছে। ওদের আবার ভাত রাঁধতে হয়েছিল, ‘বঙ্গ সন্তান’ বলে কথা।
আমাদের অপেক্ষার পালা শেষ। অবশেষে সময় হল প্লেনে ওঠার। ঢাকা থেকে লাগেজ থ্রু বুকিং হয়েছে। ফলে ঝামেলা নেই। হ্যান্ডব্যাগ নিয়ে উঠে পড়লাম।
ইকোনোমী ক্লাস পুরো ভর্তি। অবাক হলাম, এত মানুষ বিদেশ যাওয়া আসা করে? পরে জেনেছি উজবেকিস্তান “দ্বি-ধাপ জমি বেষ্টিত দেশ”। উজবেকিস্তানের নিজস্ব বা তার প্রতিবেশি দেশের কোনো সমুদ্রবন্দর নেই। সমুদ্রবন্দর পেতে প্রতিবেশি দেশ পার হয়ে তঁর পরের দেশে যেতে হয়। ফলে স্থলপথে বৈদেশিক পণ্যের আমদানি বেশ জটিল। আকাশপথ সম্ভাব্য সমাধান হলেও তা ব্যয়বহুল। তাই দিল্লী, ব্যাংকক, গুয়াঙ্গজু নানা শহর থেকে ব্যাপক লাগেজ ব্যবসা চলে। সময়ের দুই মিনিট আগেই প্লেন রানওয়ের দিকে রওনা দিল। ‘উজবেক এয়ার এর ফ্লাইট কখনও ডিলে বা ফেইল করে না’, অত্যন্ত গর্বের সাথে জানালো উজবেক বিমানকর্মী।
ফজর নামাজের সময় তাস্কখন্দ নামলাম।
টারমাকে নেমেই টের পেলাম বাইরের তাপমাত্রা বেশ কম। প্রচÐ বাতাস আছে। জোব্বার ভেতর সোয়েটার, উপরে শাল, তবুও বাতাস হাড্ডির মধ্যে ঠেকছে। ইমিগ্রেশনের ভেতরে একে একে নামাজ পড়ে নিলাম । আমেরিকা, ইংল্যান্ড থেকে আসা আমাদের অন্য সঙ্গীদের দেখলাম অপেক্ষা করছে। তাদের প্লেন এসেছে আমাদের কিছু আগে। সেই দলে পূর্ব পরিচিত কয়েকজন আছেন। কয়েকজন নতুন। পরিচয় হল। পুরনোদের মধ্যে আমার স্কুলমেট, বাল্যবন্ধু ও তরিকায় আহŸানকারী রবিন, নাম রাশেদ। বছর দুই আগে সেরহিন্দ সফরে দেখা হয়েছিল, তারপর এই দেখা। দুজনের দাড়িতেই পাক ধরেছে। তবু মনে হয় সেই ১৪-১৫ বছরেই আটকে আছি।
টুরগাইড কোম্পানির গাইড মি: গালিব আগে থেকেই উপস্থিত ছিল। কাস্টমস শেষ করে এসি বাসে তুলল। গন্থব্য হোটেল উজবেকিস্তান । আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া বাসে হিটার চালু আছে।
সকালের আলোতে তাসখন্দ শহরকে মনে হলো যেন পূর্ব ইউরোপের কোনো দেশ। অতি অল্প জনসংখ্যা । ৩-৪ তলার চেয়ে বড় বিল্ডিং চোখে পড়লোনা। আমাদেও আজকের পরিকল্পনা হোটেলে নাস্তা, বিশ্রাম তারপর দুপুরে বাংলাদেশ এম্বাসির মাননীয় রাস্ট্রদুতের নিমন্ত্রনে যোগ দেয়া। সেখান থেকে হজরত শশী র. এর মাজার ও জাদুঘর পরিদর্শন। এই জাদুঘরে হজরত ওসমান রা. সংকলিত কোরআন শরিফের কপি রক্ষিত আছে।
হোটেল উঠলাম। প্রোগ্রাম অনুযায়ী ডবল রুমে দুজন করে থাকা। উজবেক গাইড গালিব বলে দিল লিস্ট অনুসারে ঠিক যেভাবে জোড়া আছে সেভাবেই রুমে অবস্থান করতে হবে। এদেশে “অনুমোদিত টুর প্ল্যান” কাগজের বাইরে কক্ষনোই যাওয়া যাবে না। কমিউনিজম গেলেও তার ভুত এখনও যায়নি। আমাদেরও ব্রিটিশরা ছেড়েছে সেই কবে, কিন্তু ব্রিটিশ রীতিনীতি ছাড়তে পেরেছি?
এই দেশে যে কোনো রেস্তোরায় ঢুকেই চল্লিশজনের খাওয়া পাওয়া যায় না। নাস্তা হতে সময় লাগলো। নাস্তার আইটেম আন্তর্জাতিক মানের। ব্রেড, প্যান কেক, কিছু পিঠা জাতীয় মিষ্টি, ডিম, শসেজ, মধু, ফল, জুস, কফি, চা। নাস্তার পর রুমে গিয়ে গোসল করে ঘুম দিলাম।
বেলা বারোটার দিকে বালাদেশের মান্যবর রাস্ট্রদুতের নিমন্ত্রিত অতিথি হিসাবে এক রেস্তোরায় গেলাম। পুরাতন একটা বাড়িতে রেস্তোরা। সামনে ফাঁকা জায়গা, কিছুটা বসতবাড়ি ভাব আছে। ভেতরে সাধারন চেয়ার টেবিল। রাস্ট্রদুত আমাদের স্বাগত জানিয়ে পীর সাহেবের সঙ্গে পরিচিত হলেন। ছোট্ট একটা ভাষণ দিলেন। জানালেন ‘উজবুক’ শব্দটা বাংলায় যেভাবে ব্যবহার হয় এরা তেমন নয়। এরা যথেষ্ট চালাক চতুর, সবচেয়ে বড় কথা সবাই খুব আন্তরিক। বাংলায়ই কথা বলছিলেন, আমাদের গন্থব্য উনি জেনেছেন আগেই। জানালেন কয়েকটি জায়গায় উনি গিয়েছেন, কয়েকটিতে যাননি। আমাদের সফরটা সুন্দর হবে এই বিষয়ে উনার কোনও সন্দেহ নেই। উনি আরও জানালেন ইউরোপীয়রা যাঁকে তৈমুর লং (তিমুর দি লেইম) বলে তিনি এখানকার জাতীয় বীর ‘আমীর তীমুর’। তাঁর সময়েই উজবেক জাতি বিশাল এক সাম্রজ্যের অধিকারি ছিল। এখানে এই নামটা সন্মানের সঙ্গে বলতে হবে, নতুবা এরা আপত্তি জানাবে।
চিনামাটির কেতলিতে প্রথম এলো সবুজ চা। সঙ্গে ছোট ছোট চিনামাটির সুপের বাটি। এল বনরুটির মত রুটি। আকারে অনেক বড়। উপরটা শক্ত, চায়ে ভিজিয়ে খেতে হয়। খাবারের মেনু কি চা আর রুটি? কিছুটা আশাহত হচ্ছি। তখনই এলো কাবাব, একহাত লম্বা তলোয়ারের মত শিকে বড় ভেড়ার গোসত ও চর্বি টুকরা। সঙ্গে টমেটো, আরও কিছু সব্জি গাঁথা। সুঘ্রাণে পুরো ঘর ম ম করছে। গোগ্রাসে ঝাপিয়ে পড়লাম কাবাবের উপর। এ সফর বড়ই মধুর হবে!
খাওয়ার সময় কথা চলছিল রাষ্ট্রদূত সাহেবের সঙ্গে। উনি তরিকা ও পীর সম্পর্কে জানতে চাইলেন। তাঁর ধারনা ছিল শুধু পীরের ছেলেই পীর হয়। তরিকায় শরীয়ত মানা জরুরী কি না? এরকম কিছু প্রচলিত ভুলধারনা সম্পর্কে জানতে চাইলেন। মোরশেদের সাথে কথা বলে উনি খুশি হলেন। মোরশেদ সংক্ষিপ্তভাবে জানালেন আত্মশুদ্ধির জন্যই তরিকত। সাহাবীদের সময় ধরেই চলে আসছে এই শিক্ষা ব্যবস্থা। বর্তমান নকশবন্দিয়া-মোজাদ্দেদিয়া সিলসিলায় বিশুদ্ধ আকায়েদ ধারন ও শরিয়তের যথাযথ অনুসরণের ওপরেই তরিকতের সাফল্য নির্ভরশীল। আমাদেও পীরসাহেব একজন মুক্তিযোদ্ধা। মোরশেদের মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহনের সময়কার কিছু প্রসংগ এলো। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রজীবন ইত্যাদি নানারকম আলাপ হলো রাষ্ট্রদূতের সাথে। সংস্থাপন মন্ত্রনালয়ের জয়েন্ট সেক্রেটারি সাফিজুদ্দিন ভাই যোগ দিলেন আলোচনায়। রাষ্ট্রদুত সাহেব জানালেন উনার ট্রান্সফার অর্ডার হয়ে গেছে, চলে যাচ্ছেন দেশে। প্রায় দুই ঘন্টা আলোচনা ও খাওয়া পর্ব শেষে আমরা রওনা দিলাম হজরত শশী র. এর মাজার শরিফ ও জাদুঘরের উদ্দেশে।
তাসখন্দে তিনরকম চেহারার মানুষ দেখলাম- ফর্সা বোখারি (আরব), কোরিয়ান এবং ইউরোপীয় চেহারা। গালিবকে জিজ্ঞেস করলে ও বলল, ১৯৬৬ সালে ভয়াবহ ভুমিকম্পে পুরাতন তাসখন্দ শহর ধ্বংস হয়ে যায়, তখন কোরিয়া হতে বহু মানুষ স্বেচ্ছাসেবক হিসাবে এসেছিল, তারা আর ফিরে যায়নি। ফলে বর্তমান তাসখন্দের জনসংখ্যার বিশ ভাগ কোরিয়ান বা কোরিয়ান বংশোদ্ভুত।
পথে গালিব জানালো, কমিউনিজম পতনের পর হজরত ইমাম শশী র. ই বর্তমান উজবেকিস্তানের ধর্মীয় কাঠামো নির্ধারণ করে গিয়েছেন। তিনি ছিলেন আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব ও আলেম। কোরআন ও সুন্নাহ চর্চার জন্য সারাদেশে সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় কিছু বড় আকারের মাদ্রাসা চালু করেন তিনি। একইসাথে সৌদি সরকার সমর্থিত সালাফি মতবাদ থেকে সবাইকে দূরে থাকতে নির্দেশ দিয়েছেন তিনি। সালাফি মত প্রচার অলিখিতভাবে নিষেধ এই দেশে। ওলি আউলিয়াদের সন্মান করার শিক্ষা দিয়েছেন ও দেশের বিভিন্ন স্থানে থাকা মাজার সমূহ সংস্কার করার প্রোগ্রাম নিতে সরকারকে উদ্বুদ্ধ করেন। তৎকালীন প্রেসিডেন্ট করিমভের ব্যক্তিগত তত্ত¡াবধানে সেই মোতাবেক কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে সরকার। তবে এখানে ‘সুফি টুরিজম’ এর মাধ্যমে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের সরকারি চিন্তা প্রশংসার দাবীদার।
ইমামা শশী কমপ্লেক্সেই প্রথম দেখা হল বোখারা-সমরখন্দ ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা শিল্পের। আয়তকার ¯øাবের ভেতর আর্চ দরোজা, তাতে নীল পাথরের কাজ, অপূর্ব। স্থানীয় ছুটির দিন হওয়ায় মিউজিয়াম বন্ধ ছিল। ইমাম শশী র. এর মাজার জিয়ারত করে আমরা কিছু ঘুরফির শেষে ট্রেন ষ্টেশনে চলে এলাম। স্থানীয় পর্যটকের সংখ্যা নেহায়েত কম ছিল না। সবাই আমাদের সাথে ছবি তোলার জন্য উদগ্রীব, বিশেষত বোখারি মুসলিমরা।
সন্ধ্যার পরে ট্রেনে উঠলাম। সারা রাত চড়ে সকালে বোখারা। রাতের ট্রেনে খাবারের মান তেমন ভাল ছিল না। ডিম পোলাউ জাতীয় কিছু। ‘বোখারার স্বপ্নে’ তা তখন তেমন সমস্যা মনে হয়নি। বাইরে অনেক ঠান্ডা। ট্রেনে হিটার থাকায় ঘুম ভালো হলো। রাতের যাত্রায় জানালা দিয়ে শুধুই বিস্তীর্ণ প্রান্তর ছাড়া কিছু চোখে পড়লো না।
সূর্যোদয়ের সাথে ট্রেন বোখারা স্টেশনে ঢুকল। ব্যাগ ব্যাগেজ নিয়ে নামলাম। কুয়াশাময় মিষ্টি সকাল। হালকা মেঘযুক্ত আকাশ। অনেকটা আমাদের শরতের মত। আকাশে অর্ধেক চাঁদ বোখারায় স্বাগত জানাচ্ছে। আনুমানিক খৃষ্টপূর্ব ৩০০০ সালে বোখারা নগরীর পত্তন। বহুবার বহু জাতি এই শহর শাসন করেছে। এক সময় বৌদ্ধবিহার সম্বলিত শহর, পরবর্তীতে তা অগ্নিউপাসকদের হাতে যায়। রসুল স. এর পর্দার পর পরই তাঁর চাচাত ভাই খুসাম বিন আব্বাস রা. এর নেতৃত্তে ইসলাম প্রচারকগণ আসেন এই শহরে। কয়েক যুগ পওে বোখারা’ই হয়ে উঠে ইসলামের জ্ঞান, বিজ্ঞান ও আধ্যাত্মিক চর্চার কেন্দ্র। ইবনে সিনা, নাসির উদ্দিন হোজ্জা এই শহরেরই মানুষ ছিলেন। খাজা মইনুদ্দিন চিশতী র. এই অ লে লেখাপড়া ও সাধনার শুরু করেন। আমাদের আগ্রহ এই সময়টার আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ত¡বর্গ। বিভিন্ন ধরনের ছোট বড় প্রায় ১৪০টি ঐতিহাসিক স্থাপনা আছে এই শহরে, যা ইউনেস্কো হেরিটেজ হিসাবে ঘোষনা করেছে। বর্তমানে প্রায় তিনলক্ষ মানুষের এই গোটা শহরটাকেই একটি মিউজিয়াম বলা চলে।
সবাই এক হয়ে টুর বাসে উঠলাম। গন্থব্য হোটেল বোখারা প্যালেস। তিন তারকা মানের হোটেল । গন্থব্য হোটেল বোখারা প্যালেস। তিন তারকা মানের হোটেল ।
গোসল সেরে মাত্র বেরিয়েছি এমন সময় দরজায় ডাক। দেখি গালিব একটি মানিব্যাগ নিয়ে এসেছে। কার মানিব্যাগ জানতে চায়। খুলে দেখলাম ডাক্তার কবি ফজল মাহমুদের। গালিবকে বসিয়ে জামা চাপিয়ে ডাক্তারের ঘওে গেলাম। বললাম, ডাক্তার ১০০ ডলার দেনতো, উনি জোব্বা হাতড়ে মানিব্যাগ খুজতে লাগলেন। চোখমুখ সাদা করে বললেন, মানিব্যাগ বোধহয় হারায় ফেলেছি।
এয়ারপোর্ট টয়লেটে এক পরিচ্ছন্নকর্মি এই মানিব্যা পেয়ে কর্তৃপক্ষের কাছে জমা দেয়। এয়ারপোর্ট কর্তৃপক্ষ ইমিগ্রেশন রেকর্ড খুঁজে আমাদের হদিস বের করে, বাই এয়ার এই মানিব্যাগ বোখারায় পাঠায়।
লেখক : অ্যাকাউন্টিং প্রফেশনাল