/মহাপ্রেমিক মুসা 

মহাপ্রেমিক মুসা 

কালোত্তীর্ণ ভ্রমণ

মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ

পৃথিবীতে বহু মানুষ বিখ্যাত হয়েছেন তাদের ভ্রমণের জন্য। তবে পয়গম্বর মূসা আ. এর ভ্রমণ ছিলো সবচেয়ে বৈচিত্রময়, আকর্ষণীয়, উত্তেজনাকর। তিনি তার সম্প্রদায়কে নিয়ে একাধারে চল্লিশ বছর ভ্রমণ করেছেন। এই ভ্রমণকালীন তাদের জীবিকা নির্বাহের জন্য কোনো উপায় না থাকায় আসমান থেকে তাদের খাবার সরবরাহ করা হতো। যার মধ্যে বিশেষ উল্লেখযোগ্য মান্নাসালওয়ার হালুয়া এবং আবাবীল পাখির ভুনা গোশত। নবী মূসার জীবনের অসাধারণ ভ্রমণ ইতিহাস নিয়ে আমাদের এই ধারাবাহিক বিশেষ আয়োজন মহাপ্রেমিক মূসা।

এক

পথ চলতে চলতে ক্লান্ত হয়ে পড়েন হযরত মুসা আ.। বিশ্রাম নেয়া প্রয়োজন। কিন্তু উপায় নেই। এখনো যে তিনি মিশর রাজ্যের সীমানার মধ্যেই রয়েছেন। যে ভাবেই হোক, যতো তাড়াতাড়ি সম্ভব এ রাজ্য ছেড়ে তাঁকে অন্য কোনো দেশে চলে যেতেই হবে।

ভয় হয়, হয়তো ফেরাউনের লোকলস্কর তাঁকে পাকড়াও করবার জন্য এদিক ওদিক বেরিয়ে পড়েছে। কোথাও বিশ্রাম নেয়া যাবে না এখন। পেছনে পেছনে যদি এসে পড়ে সেপাই শান্ত্রীর দল তখন আর রক্ষে নেই। ফেরাউন তাকে ক্ষমা করবে না কিছুতেই। নির্ঘাত মৃত্যুদণ্ড অপেক্ষা করছে তাঁর জন্য। হত্যার বদলে হত্যা। খুনের বদলে খুন।

হযরত মুসা আ.পথ চলেন দ্রুত। কিন্তু একটু পরেই আপনাআপনি চলার গতি শ্লথ হয়ে আসে। ক্রমাগত কয়েকদিন পথ চলার ক্লান্তি শরীরে। পা দুটো টন টন করে ওঠে ব্যথায়। দুদণ্ড  জিরিয়ে নিতে পারলে শরীরটা চাঙ্গা হতো। কিন্তু তার

কোনো উপায় এখন নেই। এতোটা পথ পালিয়ে এসেও যদি শাহী লস্করের হাতে বন্দী হতে হয়।

শরীরটাকে কোনোরকমে টেনে নিয়ে পথ চলতে থাকেন হযরত মুসা। মিসর রাজ্যের সীমানা শেষ হয়ে এসেছে প্রায়। সীমানা পেরিয়ে অন্য এক রাজ্যের সীমানায় পা রেখে অনেকটা নিশ্চিন্ত হলেন তিনি। না। এতদূর আর আসবার সম্ভাবনা নেই শাহী সিপাহীদের। ধরা পড়বার ভয় আর এখন নেই।

দুই

এ রাজ্যের নাম মাদায়েন। একেবারে অচেনা এক রাজ্য। হযরত মুসা আগে কখনো আসেননি এদেশে। বিজন এক প্রান্তরে এসে বসে পড়লেন তিনি। সারা শরীর এখন অবসাদ আর শ্রান্তির দখলে। মাটিতেই শুয়ে পড়তে হলো তাঁকে। তারপর কখন যেনো দুচোখ ভরে নেমে এসেছে গভীর ঘুম বুঝতেই পারেননি।

ঘুম ভাঙলো এক সময়। সারা শরীর ব্যথায় ভরা। উঠে বসে কিছুক্ষণ ভাবলেন তিনি এভাবে এই বিজন প্রান্তরে কতোক্ষণ যে ঘুমের মধ্যে কেটেছে কে জানে? ক্ষিধে পেয়েছে খুব। কয়দিন তো একরকম অনাহারেই কেটেছে বলতে গেলে। নিকটে কোনো জনবসতির চিহ্ন নেই। কিন্তু লোকালয় খুঁজে বের করতেই হবে যে। জোগাড় করতে হবে ক্ষুধার অন্ন। পিপাসার পানি। আশ্রয়ের ঠিকানা।

মন যেদিকে চায় সেদিকেই যেতে হবে। আবার পথ চলতে শুরু করলেন হযরত মুসা। পাহাড়, প্রান্তর, বিস্তীর্ণ তৃণভূমি সবকিছু পেরিয়ে যান তিনি একে একে। তবু কোনো লোকালয় চোখে পড়ে না।

বেলা গড়িয়ে বিকেল হলো। হঠাৎ হযরত মুসা দেখলেন ঐতো খুব বেশী দূরে নয় একটা গ্রাম নজরে আসছে। সেই গ্রামের দিকেই রওয়ানা হলেন তিনি। খুব বেশী সময় লাগলোনা সে গ্রামে পৌঁছতে। সন্ধ্যার আগেই গ্রামের এক প্রান্তে এসে উপস্থিত হলেন হযরত মুসা। আর এগোনো যায় না। বিশ্রামের জন্য সেখানেই বসে পড়লেন তিনি।

কাছেই একটা বড় কুয়ো। কয়েকজন রাখাল সে কুয়ো থেকে পানি তুলে তাদের পশুগুলোকে পানি খাওয়াচ্ছে। কুয়োটাকে ঘিরে রীতিমতো ভীড় জমে উঠেছে রাখাল আর পশুদের। ছাগল ভেড়াগুলো সব ঠেলাঠেলি করে পানি পান করছে।

হযরত মুসা দেখলেন, ভিড় থেকে বেশ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে রয়েছে দুটি বালিকা। সঙ্গে তাদের কিছু ছাগল ভেড়া। পশুগুলো তৃষ্ণার্ত বোঝা যায়। বার বার পশুগুলো কুয়োর দিকে ছুটে যেতে চাইছে। আর বালিকা দুটো বার বারই ফিরিয়ে রাখছে তাদেরকে।

দেখলেই বোঝা যায়, পশুগুলোকে পানি খাওয়াতে নিয়ে এসেছে বালিকারা। কিন্তু প্রচন্ড ভিড়ের জন্য কুয়োর কাছে ঘেঁষতে পারছে না।

হযরত মুসা আ. এর মনে হলো, এতো রীতিমতো অবিচার। মেয়ে দুটির প্রতি সহানুভূতিতে ভরে গেলো হযরত মুসার মন। কতোক্ষণ ধরে যে তারা এভাবে দাঁড়িয়ে আছে আর তাদের পশুগুলোও যে কতোক্ষণ পানির পিপাসায় কষ্ট পাচ্ছে কে জানে। হযরত মুসা বালিকাদের দিকে এগিয়ে গেলেন। জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা এভাবে দাঁড়িয়ে আছো কেনো? পশুগুলোকে পানি খাওয়াবে কখন?

একটি মেয়ে জবাব দিলো, ‘আমাদের পিতা বৃদ্ধ, দুর্বল মানুষ। তাই আমাদেরকে এ পশুগুলোর দেখাশুনা করতে হয়। আমরা মেয়ে মানুষ বলে রাখালেরা আমাদেরকে পাত্তাই দিতে চায় না। কুয়োর কাছে গেলেই তারা আমাদের পশুগুলোকে তাড়িয়ে দেয়। তাই আমরা অপেক্ষা করছি। সবাই তাদের পশুগুলোকে পানি পান করিয়ে নিয়ে চলে গেলে আমরা আমাদের পশুগুলোকে পানি পান করাবার সুযোগ পাবো।’

কথা শুনে হযরত মুসা উত্তেজিত হয়ে উঠলেন। তিনি তৎক্ষণাৎ ভিড় ঠেলে কুয়োর কাছে এগিয়ে গেলেন। তারপর একটা বড় বালতি ভরে পানি তুললেন কুয়ো থেকে। তারপর একে একে বালিকাদের সকল পশুকে পানি খাওয়ালেন।

রাখালেরা বিরক্ত হচ্ছিলো এসব দেখে। কিন্তু কিছু বলার সাহস করলো না তারা। বরং অবাক হয়ে গেলো অচেনা এই যুবকটিকে দেখে। কী সুন্দর চেহারা। আর কী বলিষ্ঠ শরীর যুবকটির। তাঁর প্রতি পদক্ষেপে ফুটে উঠছে আভিজাত্য আর ব্যক্তিত্বের ঝলক।

পশুপাল নিয়ে চলে গেলো বালিকা দুটি। হযরত মুসা কাছেই একটা গাছের ছায়ায় বসে পড়লেন। ক্ষুধায় পেট মুচড়ে উঠছে। তিনি বুঝে উঠতে পারলেন না, এখন কেমন করে যোগাড় করা যাবে আহার্য। আল্লাহ্তায়ালার দরবারে প্রার্থনা জানালেন, ‘হে আমার প্রতিপালক। আমিতো এই সময় আপনার ঐ সুন্দর সামগ্রীরই মুখাপেক্ষী যা আপনি নির্ধারণ করবেন আমার জন্য।’

একটু পরেই হযরত মুসা আশ্চর্য হয়ে দেখলেন, সেই মেয়ে দুটির মধ্যে একজন দ্রুত গতিতে তাঁর দিকে এগিয়ে আসছে।

কাছাকাছি দাঁড়ালো মেয়েটি। লজ্জায় মাথা নিচু করে রইলো সে। তারপর বললো, ‘নিকটেই আমাদের বাড়ী। আপনি আমাদের বাড়ীতে আসুন। আমার আব্বা আপনাকে ডেকেছেন। আপনি আমাদের পশুগুলোকে সহজে পানি পান করিয়ে দিয়ে বিরাট অনুগ্রহ করেছেন। আমার আব্বার ইচ্ছা তিনি আপনার অনুগ্রহের বিনিময় দান করবেন।’

ক্ষণিক ভাবলেন হযরত মুসা। তিনিতো বিনিময়ের আশায় মেয়ে দুটির পশুগুলোকে পানি খাওয়াননি। অসহায় দুটি বালিকার প্রতি কর্তব্যবোধের তাগিদেই একাজ করেছেন। সুতরাং বিনিময় লাভের আহবানে সাড়া দেওয়া কি ঠিক হবে। পরক্ষণে মন পরিবর্তন হলো হযরত মুসার। ভাবলেন তিনি, যাওয়াই যাকনা মেয়েটির সাথে। এ বিদেশ বিভূঁইয়ে পরিচিতজনতো প্রয়োজন। এভাবে প্রার্থনার প্রত্যাশিত ফল প্রদান করাই হয়তো আল্লাহ্পাকের ইচ্ছা। দেখাই যাকনা কি হয়।

হযরত মুসা উঠে দাঁড়ালেন। বললেন মেয়েটিকে, ‘আমি সামনে পথ চলছি। তুমি আমার পেছনে পেছনে এসো। যদি পথ ভুল করি  পেছন থেকে বলে দিও।’ আগে আগে পথ চলতে লাগলেন হযরত মুসা। পেছনে পেছনে মেয়েটি। বাড়ী বেশী দূরে নয় তাদের। কিছুক্ষণ পরেই বাড়ী পৌঁছে গেলেন দুজনে।

মেয়েটির পিতার সঙ্গে পরিচিত হলেন হযরত মুসা। দেখলেন মেয়েটির পিতা একজন দ্বীনদার বৃদ্ধ বুজর্গ। দেখলেই মনে শ্রদ্ধা জেগে ওঠে। বৃদ্ধ বুজর্গও হযরত মুসাকে দেখে বুঝতে পারলেন, এই সুন্দর যুবক সাধারণ কোনো যুবক নয়। তীক্ষè ব্যক্তিত্বের অধিকারী এই বিদেশী যুবকটির চেহারাও কতো সুন্দর। অপার্থিব নূরের আভায় ভরে আছে তার সমস্ত মুখমন্ডল। কিন্তু সারা শরীরে একই সাথে ফুটে রয়েছে সফরের শ্রান্তি। মনে হয় আহার জোটেনি কয়েক বেলা।

খুব দ্রুত যুবকের জন্য আহারের বন্দোবস্ত করলেন তিনি। তারপর পাশে বসে আদর করে খাওয়ালেন তাঁকে। আহারের শেষে ধীরে সুস্থে জানতে চাইলেন বৃদ্ধ বুজর্গ, ‘কি নাম তোমার বাবা? কোথায় নিবাস? কী উদ্দেশ্যে আগমন তোমার? যাবেইবা কোথায়?’

হযরত মুসা একে একে খুলে বললেন সমস্ত বৃত্তান্ত। বললেন, ‘নাম আমার মুসা। নিবাস মিশর রাজ্যে। মিশররাজ ফেরাউনের পুত্র আমি। আপন পুত্র নই। পালকপুত্র। সে এক বিস্ময়কর ইতিবৃত্ত। সবই একে একে খুলে বলছি আপনাকে। শুনুন।’

 তিন

বিশাল রাজ্য মিশর। প্রায় দুই হাজার বছর ধরে এ রাজ্য শাসন করে আসছে আমালেকা খান্দানের বাদশাহ্রা। এ রাজ্যের বাদশাহ্দের উপাধি ‘ফেরাউন।’ আমালেকা খান্দানের ষোড়শ ফেরাউনের নাম ছিলো আবাবিউল আউয়াল। তাঁর শাসনামলেই হযরত ইউসুফ আ. মিশরে আসেন। হযরত ইউসুফ ছিলেন হযরত ইয়াকুব আ. এর কনিষ্ঠ পুত্র। তাঁদের বসবাস ছিলো কেনান প্রদেশে। আল্লাহ্র নবী হযরত ইয়াকুব আ. এর এক নাম ছিলো ইসরাইল। তাঁর পরবর্তী বংশধরেরাই বনি ইসরাইল নামে খ্যাত হয়ে আসছে।

হযরত ইয়াকুব আ. এর সর্বকনিষ্ঠ পুত্র হযরত ইউসুফ ছিলেন অতুলনীয় সৌন্দর্যের অধিকারী। পিতা তাঁকে খুব বেশী মহব্বত করতেন বলে তাঁর অন্যান্য ভাইয়েরা খুবই হিংসা করতো তাঁকে। তারাই একদিন বেড়াতে যাবার নাম করে হযরত ইউসুফকে নিয়ে গিয়ে বিজন বনের এক কুয়োয় ফেলে দেয়। তারপর পিতার কাছে এসে কাঁদতে কাঁদতে বলে, ইউসুফকে বাঘে খেয়ে ফেলেছে। হযরত ইয়াকুব আ. ছিলেন আল্লাহ্ নবী। তিনি নিশ্চিত জানতে পারলেন, ইউসুফ মরেনি। একদিন না একদিন ইউসুফের সন্ধান তিনি পাবেনই পাবেন। পুত্রবিরহে শোকাভিভূত হযরত ইয়াকুব ধৈর্যধারণ করেন। এভাবেই কাটতে থাকে দিন। মাস। বছর। বছরের পর বছর। ওদিকে একদল বণিক বনের বিজন কুয়ো থেকে হযরত ইউসুফকে উদ্ধার করে। মিশর রাজ্যের দিকে যাচ্ছিলো তারা। বণিকেরা অপরূপ সুন্দর তরুণ ইউসুফকেও নিয়ে চললো মিশরের দিকে। তারপর মিশরে গিয়ে অনেক টাকার বিনিময়ে গোলাম হিসেবে ইউসুফকে বিক্রয় করে দিলো আজিজে মিশরের কাছে।

শুরু হলো দাস জীবন। তাঁর উপর একে একে আসতে লাগলো বিপদ- মুসিবত। অপবাদের গøানি মাথায় নিয়ে তাঁকে ঢুকতে হলো জেলখানায়। সত্য নবী জেলখানাতেও  মানুষকে  জানাতে  থাকলেন  সত্যদ্বীনের  প্রতি  উদাত্ত  আহবান।

জেলখানার প্রহরীদেরকে বলতেন তিনি, বলো কে উত্তম? ভিন্ন ভিন্ন অনেক মূর্তি না এক পরাক্রমশালী আল্লাহ্?

এই জেলখানাতে থাকতেই হযরত ইউসুফের রূপ ও গুণের খ্যাতি চারিদিকে ছড়িয়ে পড়তে থাকলো। এক সময় ফেরাউন আবাবিউল আউয়ালের কানেও পৌঁছালো হযরত ইউসুফের অনেক প্রশংসা। তিনি ইউসুফকে ডেকে নিয়ে গেলেন নিজের কাছে। মুগ্ধ হয়ে গেলেন তিনি হযরত ইউসুফকে দেখে। তাঁর মন সাক্ষী দিলো সত্যিই হযরত ইউসুফ আল্লাহ্তায়ালার নবী।

ফেরাউন আবাবিউল আউয়াল কবুল করলেন হযরত ইউসুফ আ. এর দ্বীন। শুধু তাই নয়, হযরত ইউসুফকেই তিনি বানিয়ে দিলেন মিশর রাজ্যের ফেরাউন। বয়সও হয়েছিলো অনেক। রাজকার্য থেকে অবসর নিলেন তিনি।

হযরত ইউসুফ যখন মিশরের শাসনকার্য পরিচালনা করছিলেন সেই সময়ই তাঁর পিতা হযরত ইয়াকুব আ. এবং অন্যান্য ভাইয়েরা মিশরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করেছিলেন। ভাইদের শত্রুতার কথা মনে রাখেননি হযরত ইউসুফ আ.। ক্ষমা করে দিয়েছিলেন তাঁদেরকে।

ফেরাউন আবাবিউল আউয়াল তখন হযরত ইউসুফকে বলেছিলেন, ‘তোমার পিতা এবং ভাইয়েরা তোমার কাছে এসেছে। এখানকার সমস্ত দেশের জমিন এখন তোমারই অধিকারে। সবচেয়ে ভালো কোনো স্থানে তুমি তাঁদেরকে বসতি স্থাপন করতে বলো।’

প্রাক্তন ফেরাউনের কথামতো হযরত ইউসুফ রাআসসীস্ নামের ভূখন্ডে পিতা এবং ভাইদেরকে বসতি স্থাপন করতে বললেন।

সেই থেকে স্থায়ীভাবে মিশরে বসবাস করে আসছেন বনি ইসরাইল সমপ্রদায়। হযরত ইয়াকুব মিশরেই ইন্তেকাল করেন। তাঁর অসিয়ত মোতাবেক পুত্র হযরত ইউসুফ তাঁর পবিত্র দেহ মমি করে সিন্দুকে বন্ধ করেন। তারপর তাঁদের আদি বসবাস ফিলিস্তিন নিয়ে গিয়ে দাফন করেন।

এক সময় মৃত্যুর ডাক শুনতে পেলেন হযরত ইউসুফ। নিপুণ দক্ষতার সঙ্গে রাজ্য পরিচালনা করার পর ১১০ বৎসর বয়সে তিনিও চলে যান মহান প্রতিপালক আল্লাহ্তায়ালার সন্নিধানে।

হযরত ইউসুফ আ. এর ইন্তেকালের পর দেশের শাসন ক্ষমতা আবার চলে গেলো আমালেকা বংশের অধীনে। পরবর্তী ফেরাউনরা ছিলো কাফের। তাই স্বভাবতই বনি ইসরাইলদের প্রতি ছিলো তাদের বিদ্বেষভাব। মিশরের আদি অধিবাসীরা পরিচিত হতো কিব্তী নামে। আর হযরত ইয়াকুব আ. এর বংশধরদের বলতো তারা বনি ইসরাইল। কিব্তীদের মধ্যে মোমেনদের সংখ্যা ছিলো কম। অধিকাংশই ছিলো তারা মূর্তিপূজক। মিশরের আদি অধিবাসী নয় বলে বনি ইসরাইলদেরকে হেয় চোখে দেখতো কিব্তীরা।

সময় গড়িয়ে যেতে লাগলো এভাবে। একে একে মিশর শাসন করতে থাকেন আমালেকা বংশদ্ভূত কাফের ফেরাউনরা। প্রায় তিন শত বছর মিশরের সিংহাসনে বসলো ফেরাউন মিনফাতাহ্। সে ছিলো পূর্ববর্তী ফেরাউন দ্বিতীয় রামেশীসের পুত্র। এই ফেরাউন মিনফাতাহ্ শুধু কাফেরই নয়। সে নিজেকে দাবী করলো আল্লাহ্ বলে। ঘোষণা করে দিলো দেশবাসীর নিকট, ‘আমি তোমাদের বড় প্রভু।’ মূর্তিপূজক কিব্তীরা বিস্মিত হলো না এতে। সহজেই তারা স্বীকার করে নিলো ফেরাউনকে প্রভু বলে। কিন্তু বনি ইসরাইলরা স্বীকার করলো না এ দাবী।

ফেরাউন এ দাবী মেনে নেবার জন্য পীড়াপীড়ি করলো না বনি ইসরাইলদেরকে। কিন্তু অন্যভাবে শুরু করলো অত্যাচার। তাঁদেরকে দিয়ে সে শ্রমিকদের কাজ করিয়ে নিতো। তাঁদেরকে সে নামিয়ে দিলো দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিকের মর্যাদায়। কিবতীরা পেলো প্রথম শ্রেণীর নাগরিক হবার সুযোগ। সুযোগ বুঝে কিবতীরাও অন্যায় অত্যাচার শুরু করে দিলো প্রতিবেশী বনি ইসরাইলদের উপর।

ফেরাউনের নীতি ছিলো যেভাবেই হোক বনি ইসরাইলদেরকে অবনত রাখতে হবে। সংখ্যায় তো তারা এখন আর নগণ্য নয়। কয়েক লক্ষ জনতার এই বিশাল সংঘবদ্ধ দলটি যদি কোনো সময় বিদ্রোহের কথা ভাবতে শিখে, তাহলে এ রাজ্যের অস্তিত্ব রক্ষাই কঠিন হয়ে দাঁড়াবে। সুতরাং নিয়মিত অত্যাচার শোষণ চাপিয়ে রাখতে হবে বনি ইসরাইলদের উপর, যাতে তারা তাদের অধিকার আদায়ের দাবীতে কোনোদিনই মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে।

এভাবেই কিবতীদের উল্লাস আর বনি ইসরাইলদের রোনাজারীর মধ্য দিয়ে রাজত্ব পরিচালনা করে যাচ্ছিলো ফেরাউন। কিন্তু একরাতে এক ভয়ানক স্বপ্ন দেখে সে ঘাবড়ে গেলো খুব।  সে  স্বপ্নের  ব্যাখ্যা  জানবার  জন্য  স্বপ্নতত্ত¡বিদ জ্যোতিষীদেরকে শাহী দরবারে তলব করলো।

জ্যোতিষীরা গণনা করে জানিয়ে দিলো ফেরাউনকেÑ ‘সামনে আসছে অশুভ দিন। ইসরাইলী বংশের এক যুবক আপনার রাজত্ব ধ্বংস করে ফেলবে। স্বপ্নে সেই অশুভ ইঙ্গিতই পেয়েছেন আপনি।’

আতঙ্কিত হয়ে গেলো ফেরাউন। সে কিছু ধাত্রী নিযুক্ত করলো কিব্তী রমণীদের মধ্য থেকে, যেনো তারা খোঁজ খবর নিতে থাকে নিয়মিত বনি ইসরাইলদের প্রসূতিদের। বনি ইসরাইল বংশে কোনো ছেলে সন্তান জন্ম নিলেই যেনো সংবাদ পাওয়া যায়। আর ঘোষণা করে দিলো নতুন আইন। এখন থেকে বনি ইসরাইলদের ঘরে ছেলে সন্তান জন্ম নিলেই তাকে হত্যা করা হবে।

কিন্তু ধাত্রীরা ছিলো বনি ইসরাইলদের প্রতি সহানুভূতিপ্রবণ। ফেরাউন যখন জানতে পারলো একথা, তখন আর এক দল লোককে নিযুক্ত করলো একাজে। তারা নিয়মিত অনুসন্ধান করে ফিরতে লাগলো বনি ইসরাইলদের প্রতিটি গৃহ। কোনো ঘরে ছেলে জন্ম নিলেই তারা তৎক্ষণাৎ হত্যা করে ফেলতো নবজাতককে।

এরপর থেকে বনি ইসরাইলদের সন্তানসম্ভাবা মায়েরা ভয়ে ভয়ে দিন কাটাতে থাকেন। তাদের চোখের সামনেই তাদের ছেলে সন্তানদেরকে হত্যা করে ফেলা হয়। নিরুপায় মায়েরা, অসহায় পিতারা নীরবে অশ্রæবিসর্জন করতে থাকেন আর আল্লাহ্তায়ালার সাহায্য পাওয়ার আশায় দিন গুণতে থাকেন। সামনে অন্ধকারাচ্ছন্ন ভবিষ্যত। কে জানে কখন হবে এই অসহনীয় দুষ্কালের দিবাবসান? (চলবে..)

লেখক: কবি ও গদ্যশিল্পী