/মেপল পাতার দেশে..কানাডা

মেপল পাতার দেশে..কানাডা

মোহম্মদ আবদুল কাইউম 

এক 

১৯৯৯ এর ২৪ জুলাই বিকেল চারটার দিকে আমরা কানাডায় এসে পৌঁছলাম। টরন্টো শহরের ‘পিয়ারসন বিমান বন্দরে’ আমাকে ও আমার স্ত্রীকে অভ্যর্থনা জানাতে পুত্র সাজেদুল কাইউম সুমন, পুত্রবধূ লুসান্তা এবং কন্যা গওসিয়া খান শিউলি, জামাতা মাহবুব আনম খান ও তাদের দুই পুত্র-কন্যা এলভিনা ও মুশফিক এসেছিল। পৃথিবীর অনেক বিমানবন্দরের ন্যায় এই বিমানবন্দরেরও নামকরণ হয়েছে দেশের একজন বরেণ্য ব্যক্তির নামানুসারে। ১৯৬৭ সালে কানাডার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন লিস্টার পিয়ারসন (খবংঃবৎ চবধৎংড়হ)। কানাডায় নারীদের সমান অধিকার প্রতিষ্ঠায় অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন তিনি। তাঁর নামানুসারে রাখা এই পিয়ারসন বিমানবন্দর কানাডার ব্যস্ততম এয়ারপোর্টগুলোর একটি। 

বিমানবন্দরে ইমিগ্রেশন অফিসার আমাদের পেশা এবং উদ্দেশ্য শুনে পাসপোর্টে সানন্দে প্রবেশাধিকার সীল দিয়ে শুভ-কামনা জানিয়ে বিদায় দিলেন। ভদ্র-মহিলার আন্তরিক ব্যবহারে মুগ্ধ হলাম। 

মালপত্র পেতে বিশেষ দেরি হলোনা। কিন্তু, কাছে কিনারে কোনো ট্রলি দেখলামনা। দূরে এককোণে এক সারি ট্রলি দেখতে পেয়ে কাছে গিয়ে দেখি সবই তালাবদ্ধ। নির্দিষ্ট মুদ্রা না পেলে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র তালা খুলে দেবে না। কানাডিয়ান মুদ্রা আমাদের সঙ্গে ছিলনা। নিকটবর্তী ‘মানি চেঞ্জারে’ গিয়ে একটা ‘ট্রাভেলার্স চেক’ ভাঙিয়ে কিছু মুদ্রাসহ কানাডিয়ান ডলার সংগ্রহ করে নিলাম। তারপর যথারীতি ট্রলি উদ্ধার করে মালপত্র তাতে চাপিয়ে কাস্টম্স কাউন্টারের দিকে এগিয়ে গেলাম। 

কাস্টম্সের খুব বেশি কড়াকড়ি দেখলাম না। যদিও দেশে শুনে এসেছিলাম, এখানে কাস্টম্সের কর্মচারীরা মালপত্র উল্টে-পাল্টে তন্নতন্ন করে খোঁজে, কেউ কোন খাদ্যদ্রব্য এনেছে কি না। এখানে বাইরের কোনো দেশ থেকে খাদ্যদ্রব্য আনা সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। 

‘ইমিগ্রেশন’ এবং ‘কাস্টমস’ এলাকা পার হয়ে বাইরে এসে সকলের হাসিমুখ দেখলাম। অনেকদিন পরে তাদের সঙ্গে দেখা। গাড়িতে করে সুমনের এ্যাপার্টমেন্টের দিকে সবাই রওয়ানা হলাম। আবহাওয়া অনেকটা আমাদের দেশের মতোই। বেশ গরম। প্রশস্ত রাজপথ ধরে গাড়ি এগিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মাঝে রাস্তার দুপাশে উঁচু দালান। চারপাশে বেশ গাছপালাও দেখা গেল। দেখলাম ‘ওক’ (ঙধশ), ‘পাইন’ (চরহব), ‘মেপল’ (গধঢ়ষব), আর ‘চিরহরিৎ বৃক্ষ’। ক্রিসমাস (ঈযৎরংঃসধং) বা বড়দিনের সময় আর সব গাছের পাতা ঝরে গেলেও এই চিরহরিৎ বৃক্ষের পাতা ঝরে পড়ে না। তাই, ‘ক্রিসমাস-ট্রি’ হিসাবে এই গাছের খুব কদর। 

কানাডায় নানারকমের গাছের মধ্যে মেপল গাছের সংখ্যাই সবচেয়ে বেশি। প্রকৃতপক্ষে কানাডা হচ্ছে মেপল পাতার দেশ। কানাডার জাতীয় বৃক্ষও এই মেপল বৃক্ষ। এদেশের জাতীয় পতাকায় শোভা পায় সাদার উপর লাল রং-এর মেপল পাতা এবং তার দু’পাশে লাল রঙের মোটা রেখা। ১৯৬৫ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি কানাডার এই পতাকা নির্ধারিত হয়। তার অনেক আগেই এই মেপল পাতা কানাডার প্রতীকরূপে গৃহীত হয়েছিল। ১৮৬৭ সালে, একজন স্কুল শিক্ষক ‘দ্য মেপল লীফ ফর এভার’ (ঞযব সধঢ়ষব ষবধভ ভড়ৎবাবৎ) বা ‘মেপল পাতা চিরঞ্জীব’— এই শিরোনামে একটি গান রচনা করেছিলেন। গানটি এত জনপ্রিয় ছিল যে, দীর্ঘকাল ধরে এই গান ছাত্রছাত্রীদের সমবেত সঙ্গীতরূপে স্কুলে গীত হতো।

মেপল গাছ শুধু যে কানাডায় দেখা যায় তা নয়, বিশ্বের উত্তর-গোলার্ধে বা শীত প্রধান অ লে এই বৃক্ষ প্রচুর জন্মে। এ গাছের পাতা, বর্ণে এবং আকৃতিতে খুবই সুন্দর। বিশ ফিট থেকে ১১৫ ফিট পর্যন্ত এই গাছের উচ্চতা। পাতার রং প্রথমে সবুজ, শরৎ ঋতুর স্পর্শে তা হলুদ এবং পরে কমলা বর্ণে শোভা পায়। শীত আসার সঙ্গে সঙ্গে শুকনো লাল মেপল পাতা ঝরে নিঃশেষ হয়ে যায়। এ গাছের ফুল খুব ছোট, সবুজ বা হলদে রং এর হয়। আরো মজার কথা, আমাদের দেশের খেজুর গাছের রসের মতো এই মেপল গাছের কাÐেও মিষ্টি রস রয়েছে, যা থেকে মেপল চিনি বা মেপল মধু তৈরি হয়।

কানাডার জাতীয় ক্রীড়া হচ্ছে আইস-হকি খেলা। টরন্টোর বিখ্যাত আইস-হকি দলের নাম রাখা হয়েছে ‘টরন্টো মেপল লীফ’। আর এই আইস-হকি খেলার স্টেডিয়ামেরও নাম ‘মেপল লীফ গার্ডেন’। 

মেপল পাতার দেশ এই কানাডায় এসে আমরা টরন্টো শহরে রাত কাটালাম। কানাডা বিরাট দেশ। আয়তনে পৃথিবীর দ্বিতীয় বৃহত্তম। পৃথিবীর স্থল-ভাগের সাত-শতাংশ হলো এই কানাডা। দক্ষিণে আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্র আর বাকি তিনদিকে তিন সমুদ্র— আটলান্টিক মহাসাগর, আর্কটিক মহাসমুদ্র এবং প্রশান্ত সাগর। এই তিন সমুদ্রে ঘিরে রাখা কানাডার দু’লক্ষ চুয়াল্লিশ হাজার কিলোমিটার তটরেখা পৃথিবীর মধ্যে দীর্ঘতম। টরন্টো, অন্টারিও প্রদেশেরই একটি নগরী। এটি কানাডার বৃহত্তম নগরীও বটে। অন্টারিও কানাডার দ্বিতীয় বৃহত্তম প্রদেশ। কুইবেকের পরেই এর স্থান। কানাডার রাজধানী অটোয়া এই অন্টারিও প্রদেশেই অবস্থিত। 

কানাডা একটি ফেডারেশন রাষ্ট্র। ফেডারেশন হচ্ছে এমন এক রাজনৈতিক ব্যবস্থা, যাতে একাধিক রাজ্য বা রাষ্ট্র বৈদেশিক বিষয়, প্রতিরক্ষা মুদ্রা ইত্যাদি কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে অর্পণ করে অন্যান্য ক্ষমতা ও আঞ্চলিক শাসনব্যবস্থা নিজ নিয়ন্ত্রণে রেখে সম্মিলিত ও চুক্তিবদ্ধ হয়। এই ফেডারেশনের অধীনে রয়েছে দশটি প্রদেশ এবং তিনটি ‘টেরিটোরিস’ বা অঞ্চল বিশেষ। কানাডীয় ফেডারেশন ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১ জুলাই সংগঠিত হয়। প্রথমে মাত্র চারটি প্রদেশ নিয়ে এই ফেডারেশনের সূত্রপাত। পরবর্তীকালে আরো অনেক প্রদেশ এ-অঞ্চলে সংযুক্ত হয়। পয়লা জুলাই কানাডার জাতীয় দিবস হিসাবে পালিত হয়। এদিন সরকারি ছুটির দিন। 

২৫ জুলাই সকালে আমরা, ছেলে সুমনের ৩৫ নম্বর চার্লস স্ট্রিট থেকে রওয়ানা হলাম কন্যা শিউলির বাসার দিকে। ওরা থাকে শহরের পূর্বপ্রান্তে স্কারবরোর লরেন্স এভিনিউতে। শিউলির বাসায় আমরা প্রায় আট-নয়দিন থাকব। তাই দরকার মত বেশ কিছু জামা-কাপড় একটি সুটকেসে ভরে সুমনদের গাড়িতে রওয়ানা হলাম। গাড়ি চালাচ্ছে আমাদের পুত্রবধূ লুসান্তা। গাড়িতে উঠেই এখানকার নিয়ম অনুযায়ী কোমর বেঁধে বসালাম। অর্থাৎ এদের ভাষায় ‘সিটবেল্ট’ বাঁধলাম। বাংলায় প্রচলিত প্রবাদ অনুযায়ী আমরা কোনো কাজ করার সময় শক্ত করে কোমর বেঁধে নেই; তা কঠিন কোনো কাজই হোক বা ঝগড়া করাই হোক। অবশ্য লোক-ছড়ায়ও দেখি ‘হুলো বেড়াল’ কোমর বাঁধতে কসুর করে নি। ‘সিটবেল্ট’ বাঁধার এই ট্রাফিক নিয়মের মূল কারণ হলো, বড় রকমের কোনো দুর্ঘটনা এড়ানো। তবে, এই ট্রাফিক নিয়ম এত কড়াকড়িভাবে পালন করা হয় যে, চালক গাড়িতে উঠে বসেই নিজের সিটবেল্ট আগে বেঁধে নেয় এবং সঙ্গে সঙ্গে সহযাত্রীকে তা বাঁধতে অনুরোধ করে। আর, কোনরকম অন্যথা হলে কমপক্ষে ১০০ ডলার অর্থ দিতে হয়। 

টরন্টোর রাস্তায় নেমে প্রথম যে মন্ত্রটি শিখতে হয়েছে, তা হলো ‘ডানে চলো’। আমাদের দেশে সবাই ‘কিপ লেফট’ বা ‘বাঁয়ে চলো’ এই নিয়ম অনুসরণ করে। সব গাড়ি-ঘোড়া রাস্তার বাঁ দিক দিয়ে চলে। টরন্টো শহরে উল্টো ব্যাপার; ছোট-বড় সব গাড়ি দ্রুত ছুটছে রাস্তার ডান দিক ধরে। যারা ‘কিপ-লেফট’ নিয়ম সারাজীবন মেনে চলেছে, তাদের পক্ষে এই নতুন নিয়মে অভ্যস্ত হওয়া সময়-সাপেক্ষ।

সেদিন ছিল রোববার। তা সত্তে¡ও রাস্তায় গাড়ির কোন কমতি ছিল না। আধ ঘণ্টার মধ্যেই বৌমা আমাদের গন্তব্য স্থলে নিয়ে পৌঁছল। দেখলাম, সে গাড়ি বেশ ভালই চালায়। শিউলিরা থাকে সেই ৩৯৫০ লরেন্স এভিনিউ-এর চার তলায়, ৪০৮ নম্বর এ্যাপার্টমেন্টে। এখানে দেখলাম সবগুলো এ্যাপার্টমেন্ট ভবনে সুন্দর নিরাপত্তা ব্যবস্থা। যাদের কাছে চাবি রয়েছে, তারাই শুধু পুরো ভবনের সদর দরজা খুলতে পারে। আমাদের মতো আগন্তুকদের জন্য রয়েছে ভিন্ন ব্যবস্থা। প্রবেশ পথের পাশেই দেয়ালে ঝোলানো রয়েছে টেলিফোন কী-বোর্ড, যার সঙ্গে প্রতিটি এ্যাপার্টমেন্ট-এর সরাসরি সংযোগ রয়েছে। আমরা সেই কী-বোর্ডের ৪০৮ নম্বর ডায়াল করার সঙ্গে সঙ্গে শিউলিদের ফোন বেজে উঠল। আমাদের নাতনি এলভিনা টেলিফোন ধরেই বলল, “দাঁড়াও দরজা খুলে দিচ্ছি”। টেলিফোনেই সে দশ নম্বর ডায়াল করার সঙ্গে সঙ্গে দরজায় একটি সংকেত বেজে উঠল। আমরা দরজা টান দিয়েই তা খুলে গেল। আরো মজার কথা শুনলাম, ওরা প্রায় সঙ্গে সঙ্গে টেলিভিশনের ৪০ নম্বর চ্যানেল টিপ দিয়ে প্রবেশদ্বারের ছবি দেখতে পেল টেলিভিশনের পর্দায়। দেখলো কে বা কারা এসেছে। 

চার তলায় উঠেই দেখি লিফটের পাশেই আমাদের অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে মেয়ে শিউলি, জামাতা মাহবুব এবং তাদের দুই ছেলেমেয়ে এলভিনা ও মুশফিক। ঘরে ঢুকেই দেখি আরেকটি বিস্ময় আমাদের জন্য অপেক্ষা করছিল। আজ ২৫ জুলাই স্ত্রী ড. রাজিয়া সুলতানার জন্মদিন। তাই নাতনি এলভিনা নিজের হাতে তৈরি করেছে ‘বার্থ-ডে কেক’ (ইরৎঃযফধু পধশব)। কেক তৈরি সে স্কুলের কুকিং ক্লাসেই শিখেছে।(চলবে..)

লেখক: সাবেক অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়