আবদুস সামাদ ফারুক
গারো পাহাড়ের পাদদেশে অবস্থিত ব্রহ্মপুত্র বিধৌত কালিজিরা তুলসীমালার সুগন্ধমাখা স্বর্ণালী শস্যের শোভাময় এক নান্দনিক অনুভবের জনপদ শেরপুর। উত্তরে ঘন মেঘের সঞ্চারণশীল ভারতের মেঘালয় রাজ্য, তার পার্শ্বেই আসাম যা এককালে কামরূপ-কামাক্ষা নামে পরিচিত যাদুমন্ত্র বিদ্যার জন্য বিখ্যাত, শেরপুর তার অংশ ছিল। প্রমত্তা ব্রহ্মপুত্র যা যমুনা নদীর জন্মের পূর্বে পদ্মার চেয়েও তিনগুণ প্রশস্ত ছিল তা দক্ষিণ দিকে শেরপুরকে বাংলাদেশের মূল ভূখন্ড থেকে বিচ্ছিন্ন করে রেখেছিল অন্যদিকে উত্তরের শ্বাপদসংকুল গারো পাহাড় বন্যপ্রাণীর অভয়ারণ্য।
শেরপুরের প্রথম জমিদার শের আলী গাজীর নামেই শেরপুর। যদিও পূর্বে “শেরপুর” বানান ছিল “সেরপুর”। জামালপুর জেলা সদর ও শেরপুর জেলা সদরের মধ্যবর্তী ১৬ কি.মি. এলাকা জুড়েই ব্রহ্মপুত্র নদী প্রবাহিত ছিল। জামালপুর থেকে শেরপুরে আসতে এক নৌকা পারাপারে লোক সংগ্রহ করতে দশ কড়ি বা কাহন খরচ করতে হতো বলে ঐতিহাসিকগণ শেরপুরের আদিনাম “দশ কাহনিয়া শেরপুর” মর্মে উল্লেখ করেন। ১ কাহন =১ টাকা, মোঘল আমল থেকেই এই কৃষিসমৃদ্ধ জনপদ “পরগণা দশ কাহনিয়া বাজু” নামে পরিচিত ছিল।
বারোভূঁঞাদের শিরোমনি ঈসা খাঁর অধীনে ৪ জন গাজী ছিলেন, তন্মধ্যে ফজল গাজী জয়দেবপুর তথা গাজীপুরের মালিক হন। তাঁদের একজন শেরআলী গাজী ঈশা খাঁর সাহায্যে শেরপুর অধিকার করেন এবং পরগণার মালিক হন। উল্লেখ্য ঈসা খাঁর রাজত্বকাল ১৫৭৬ খ্রি: থেকে ১৫৭৬ খ্রি: পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
দরবেশ শাহ্ কামাল (রহ:)
জামালপুরের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট Mr. Donongh রোজনামচায় লেখেন যে, ৯১০ বাংলা ১৫০৩ ইংরেজি সালে শাহ্ কামাল মুলতান হতে বাংলায় এসে বর্তমান শেরপুরের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে ব্রহ্মপুত্র নদের অপরপারে দুরমুটে স্থায়ী হয়েছিলেন। তাঁর মাজার মেলান্দহ উপজেলা, জামালপুর জেলায় অবস্থিত। তৎকালীন জমিদারগণ তাকে কড়ইবাড়ী পর্যন্ত নিষ্কর ভূমি দান করেন। কথিত আছে যে, তিনি ব্রহ্মপুত্রের স্রোত পূর্বপাড় দিয়ে সরিয়ে দেন।
শেরপুরের জমিদার বিদ্বান ও সুলেখক হরচন্দ্র চৌধুরীর “সেরপুর বিবরণ” ও “বংশানুচরিত” গ্রন্থে রামনাথ নন্দীর জমিদারী প্রাপ্তির বিবরণ লিপিবদ্ধ রয়েছে।
নবাবী আমলে দর্শায় কানুনগো সেরেস্তা প্রতিষ্ঠিত হয়। রমাবল্লভ মজুমদার কানুনগো দপ্তরে কাজ করতেন । রমাবল্লভ বৈদ্য বংশীয় এক রূপবতী কন্যা পদ্মগন্ধাকে বিবাহ করেন। শেরআলি তার iƒ‡c বিমুগ্ধ হয়ে রমাবল্লভকে দুর্গম প্রদেশে নিয়ে হত্যা করেন। রমাবল্লভের শিশুপুত্র ছয় বছর বয়সী রামনাথ ও দুঃখিনী মাতা খোয়াসপুর টুন্ডা নগরে সুবেদার সাহাবাজ খাঁর নিকট বিচারপ্রার্থী হলে আরবী কেসার বিচারমতে প্রাণদন্ডের পরিবর্তে শেরআলির সর্বস্ব বাজেয়াপ্ত হয় এবং রামনাথ নন্দী এই পরগণার জমিদারী লাভ করেন। ইহার সময় কাল 994 বঙ্গাব্দ 1593 খ্রিস্টাব্দ। এভাবে শের আলী গাজীর জমিদারী চলে যায়। শের আলী গাজীর সমাধি শেরপুর সদর উপজেলার গাজীর খামার গ্রামে রয়েছে। মুসলমান ঐতিহাসিক কেহ কেহ একে চক্রান্ত বলে অভিহিত করেন এবং এর সাথে ভিন্নমত পোষণ করেন।
রামনাথ নন্দী নবাব সরকার হতে চৌধুরী খেতাব লাভ করেন। তার পরামর্শদাতা বাণীবল্লভকে প্রচুর অর্থ সম্পদ দান করেন। রামনাথ জমিদারী প্রাপ্তির পর দর্শাতে বাস করতেন। উল্লেখ্য এখনো দর্শা নামে একটি নদী গারো পাহাড় থেকে নেমে এসে নালিতাবাড়ী ও হালুয়াঘাট উপজেলায় প্রবাহিত হয়েছে। ধোবাউড়া উপজেলায় দর্শা নামে একটি গ্রাম আছে। রামনাথের পুত্র শ্রীকৃষ্ণ, শ্রীকৃষ্ণের পুত্র জগজ্জীবন দর্শা পরিত্যাগ করে শেরপুর শহরের কসবা চাকলার গৃদা নারায়ণপুর নয়আনি বাড়ীর স্থানে গৃহ নির্মাণ করে জমিদারী পরিচালনা করেন।
বাংলা ১১৩২ খ্রিস্টাব্দে রাজস্ব জমা প্রদানে ব্যর্থ হওয়ায় শেরপুরের জমিদার মোদনারায়ণকে মুর্শিদাবাদে কারারুদ্ধ করা হয়। তিনি জমিদারী ইস্তফা দেন। তার প্রধান আমাত্য আদিত্যরাম নাগ নবাবকে সেলামী প্রদান করে জমিদারী সনদ ফিরিয়ে আনেন। ১১৫৫ সালে মোদনারায়ণের মৃত্যু হলে ভ্রাতুষপুত্র সূর্য্যনারায়ণ জমিদারীর অধিকার লাভ করেন।
মুসলমান রাজত্ব কালে বঙ্গদেশে রাজস্ব ও ভূমি ব্যবস্থাপনায় তিন প্রকারের বিভাগ হয়: সম্রাট আকবরের রাজস্বমন্ত্রী টোডার মল্লের সময় ১৫৮২ খ্রি. সরকার বাজুহা নামকরণে ২২ ভাগে বিভক্ত করা হয়। ১৭২২ খ্রি. নবাব জাফর খাঁর সময়ে বঙ্গদেশকে ১৩ চাকলায় বিভক্ত করা হয়। দেওয়ান হোসেন সাহেবের সময়ে পরগণা ওয়ারি বিভক্ত করা হয়।
ছিয়াত্তরের মন্বন্তর:
বাংলা ১১৭৬; ১৭৬৯ খ্রিস্টাব্দে ছিয়াত্তরের মন্বন্তর সংঘটিত হয়। এই দুর্ভিক্ষের তাড়নায় সন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহের সূচনা হয়। অন্যদিকে জমিদারীর রাজস্ব বাকী পড়ায় ১৭৭৩ খ্রিস্টাব্দে শেরপুরের জমিদার কীর্তিনারায়ণকে ঢাকায় কারারুদ্ধ করা হয়। ১৭৮৩ খ্রিস্টাব্দে ব্দে সন্যাসী বিদ্রোহ দমনে জামালপুর Cantonment স্থাপন করা হয়। ঐ স্থানে পূর্বে সন্যাসীদের আড্ডা ছিল। ইহাকে সন্যাসীগঞ্জ বলা হতো। জামালপুর টাউন সন্যাসীগঞ্জ বলে পরিচিত ছিল, পরে সিংহজানী নামকরণ করা হয়।
১৭৮৬ সালে ভুপালগির সন্যাসী চেলা ও দলবলসহ শেরপুরে আর্বিভূত হয়। সন্যাসী ও ফকির বিদ্রোহ দমনে ১লা মে ১৭৮৭ সালে ঢাকা জেলাকে বিভক্ত করে ময়মনসিংহ জেলা স্থাপন করা হয়।
শেরপুর পরগণার অধিকাংশ স্থান জঙ্গঁলাকীর্ণ ছিল তজ্জন্য শেরপুর টাউনের পশ্চিমভাগে মৃগী নদীর পূর্বপাড়ে কালীগঞ্জে ১৮০৭ খ্রিস্টাব্দে ১২১৪ সালে মহকুমা ও Cantonment স্থাপিত হয়। Mr. Maxual প্রথম ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ লাভ করেন।
১৮১২ সালে সুসঙ্গের (দুর্গাপুর এলাকা) অর্ন্তগত সফাতি শাহ্ সুসঙ্গ ও শেরপুর পরগণার পাহাড়ী এলাকা নিয়ে করপ্রদ স্বাধীন রাজা হবার জন্য ময়মনসিংহের কালেকটর Mr. Legros এর নিকট দরখাস্তসহ সাক্ষাৎ করেন। তবে তার আবেদন বোর্ড অব রেভিনিউ না-মঞ্জুর করেন। শেরপুরের জমিদারী ভাগ হয়ে যাওয়ায় ও চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জন্য অতিরিক্ত জমা বৃদ্ধি পাওয়ায় জমিদারগণ অধিকহারে খাজনা আরোপ করেন।
মহামহোপাধ্যায় চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার:
চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার শেরপুর শহরের সন্নিকটবর্তী বাগরাকসার অধিবাসী, টোলের পন্ডিত ছিলেন। শেরপুরের বিদ্বান জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী তার বইসমূহ মুদ্রণ করে তাকে জগৎ বিখ্যাত করে তোলেন। তাকে “নব কালিবাস” বলা হয়।
তার প্রণীত গ্রন্থের বিবরণ:
মহাকাব্য-সতীপরিনয়, চন্দ্রবংশ
খন্ডকাব্য- প্রবোধশতক, রসশতক, বীরপ্রশস্তি, যুবরাজ প্রশস্তি, আনন্দ তরঙ্গিনী, ব্রহ্মস্ত্রোত্র, গনেশস্তোত্র, সরস্বতী স্তোত্র, বিষ্ণুস্তোত্র, গঙ্গাস্তোত্র, ভাব পুষ্পাঞ্জলি।
নাটক- কৌমুদি সুধাকর
অলংকার- অলংকার সূত্র
বৈদিক ব্যাকরণ- কাতন্দ্র: ছন্দ প্রক্রিয়া।
ন্যায়- কুসুমাঞ্জলির টিকা
কুসুমাঞ্জলির টিকা পড়ে কাউয়েল, দয়েবার, ম্যাক্সমুলার প্রভৃতি বিলাতের বড় বড় পন্ডিতেরা চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কারের ভূয়সী প্রশংসা করেন। হরচন্দ্র চৌধুরী শেরপুরের নয়আনী বাড়ীর জমিদার বিদ্বান ও সুলেখক ছিলেন, তার জেষ্ঠ্যপুত্র চারুচন্দ্র চৌধুরী এবং তার পুত্র কিরণ চন্দ্র চৌধুরী। শেরপুর শহরে সবচেয়ে প্রাচীন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, “ভিক্টোরিয়া একাডেমি” তিনি প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি “চারুযন্ত্র” নামে মুদ্রণযন্ত্র শেরপুর শহরে স্থাপন করেন। ১৮৮১ সালে “চার্বুার্তা” সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। ১৩০০ বঙ্গাব্দ শেরপুর শহর থেকে ময়মনসিংহ শহরে “চারুযন্ত্র” স্থাপন করা হয়। ১৩০১ বঙ্গাব্দ থেকে “চারু মিহির” পত্রিকা প্রকাশিত হয়। মীর মশাররফ হোসেনের “বিষাদ সিন্ধু” চারুপ্রেস থেকে প্রথম প্রকাশিত হয়। স্বভাব কবি গোবিন্দ চন্দ্র দাস চারু বার্তায় নিয়মিত লিখতেন।
হরচন্দ্র চৌধুরী ১৮৭২ সালে, ১২৭৯ বঙ্গাব্দে “সেরপুরের বিবরণ” কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। তিনি বহু দুর্লভ গ্রন্থ সংগ্রহ করে শেরপুরে হেমাঙ্গ লাইব্রেরি ও চিকিৎসা সেবার জন্য মহারানী দাতব্য চিকিৎসালয় প্রতিষ্ঠা করেন। মহারানী ভিক্টোরিয়ার জুবিলী উপলক্ষে ১৮৮৭ সালে মাইনর স্কুল “ভিক্টোরিয়া একাডেমি” প্রতিষ্ঠা করেন। বর্তমানে ইহা একটি হাইস্কুল যা স্বনামে উজ্জ্বল।
প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের শান্তি স্থাপন উপলক্ষে ১৯১৯ খ্রি:-এ Gobinda Kumar Peace Memorial Institution (GKPM) স্থাপিত হয়। জমিদার শ্রী গোপাল দাস চৌধুরী, শ্রীযুক্ত সতেন্দ্র মোহন চৌধুরী, শ্রীযুক্ত সতীন্দ্র কুমার চৌধুরীদের অর্থ সাহায্যে এই প্রতিষ্ঠানটি স্থাপিত হয়।
গড় জরিপা ও মজলিস খাঁ হুমায়ুন:
১৪৮৭-১৪৯০ খ্রি: পর্যন্ত দ্বিতীয় ফিরোজশাহ্ বাংলার শাসনকার্য পরিচালনা করেন। তৎকালে দলিপা নামে, ভিন্নমত রয়েছে জরিপ শাহ একজন শেরপুরে রাজত্ব করতেন। গড় জরিপা ছিল তার রাজধানী। ১৪৯১ সালে দ্বিতীয় ফিরোজশাহ্ এর মজলিস খাঁ হুমায়ুন শেরপুর আক্রমণ করেন। দলিপাকে হত্যা করে এই স্থান দখল করে শেরপুরে মুসলমান শাসনের সূচনা করেন। ইহা ময়মনসিংহে প্রথম মুসলমান শাসনের সূত্রপাত। মজলিস খাঁ হুমায়ুন দশ কাহনিয়ার জংগল পরিস্কার করে তা আবাদযোগ্য করেন। গড় জরিপা বর্তমানে শেরপুর শহর থেকে ৮ মাইল দূরে অবস্থিত। ১১০০ একর জমির উপর এই গড় প্রস্তুত হয়েছিল । ৭টি মাটির প্রাচীর দ্বারা এই গড় বেষ্টিত ছিল। ২টি প্রাচীরের ভিতর পরিখা ছিল। পরিখাগুলি অনুমান ৬০ হাত প্রশস্ত এবং প্রাচীরগুলি উচ্চতায় ২১/২৫ হাত। পরিখা ব্যতীত অনেকগুলি পুকুর ছিল। তাছাড়া মন্দির ও মসজিদ ছিল। গড়ে প্রবেশ করার জন্য চারদিকে চারটি দ্বার আছে। পূর্বদিকে “কোমদোয়ারী, পশ্চিম দিকে “পানিদোয়ারী”, দক্ষিণ দিকে “সমসকার দেউড়ি” এবং উত্তর দিকে “খিড়কি দোয়ারী” বলা হতো। পানিদোয়ারী নামক দ্বারের সমীপে দুইটি প্রস্তর ফলক পড়ে ছিল। প্রথম জংগলের বাহিরে একটি জলাশয় ছিল, তার নাম বাজার খার পুস্কুরণী। পুস্কুরণীর উত্তর পার্শ্বে একখন্ড প্রস্তর আছে। ইহার উত্তরে কাদির পীরের দরগা নামে একটি মসজিদ ছিল। ১৩০৪ বাংলা ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে পরিখা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখন অধিকাংশ স্থান বসতি ও কৃষি জমি। পশ্চিম দিকের কালিদহ সাগরে নৌকার ন্যায় জলময় জংগলপূর্ণ কতকটা স্থান আছে ইহাকে কোষা বলা হতো। মজলিস খাঁ হুমায়ুনের কবরের উপর যে পাথর খানা ছিল তা জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরী The Asiatic Society of Bengal – এ পাঠায়ে দেন।
Mr. Blockman তাহার মর্মোদ্ধার করেন যা নিম্নরূপ:
In the name of God, the merciful, the clement. There is no God but Allah, Mohammad is Allah’s Prophet…O, God bless Mohammad, the elected and Ali the chosen and Fatima the pure and Hasan…and Hasan… built …The king of the age and period saifuddunya waddin Abul Muzaffar Firoz Shah, the king, May God perpetuate his kingdom and his rule! This (vault) was completed in the blessed….Ramzan.
টিপু শাহ, করিম শাহ, ছপাতি শাহ
কোন কোন লেখক করিম kvn&কে শের আলী গাজীর পূত্র উল্লেখ করেছেন। করিম kvn&র বড় পুত্র ছফাতি শাহ্, পরে ছান্দি বিবি’র গর্ভে জন্ম নেন টিপু শাহ্। করিম শাহ্’র বাল্য নাম চাঁদগাজী। মাতৃসূত্রে হাবিবুল্লাহ শাহ্ ফকির ও নুরশাহ্ ফকিরের ভাগ্নে করিম শাহ্। করিম শাহ্’র জন্ম 1710 সালে। করিম শাহ্’র মার মৃত্যু হলে পুকুরকান্দায় তাকে সমাহিত করা হয়। গ্রামটি ধোবাউড়া উপজেলায়। নেত্রকোনা জেলার দুর্গাপুর উপজেলায় শংকরপুর গ্রামে করিম শাহ্ তপস্যা শুরু করেন। শংকরপুরে ছফাতি শাহে্র জন্ম হয়। করিম শাহের মতোই ছফাতি শাহ্ তপস্যা গুণে ঐশ্বরিক শক্তির অধিকারী হন। করিম শাহে্র 5জন স্ত্রী ছিল। করিম শাহে্র প্রথম স্ত্রীর গর্ভজাত সন্তান ছফাতি শাহ্ ও কনিষ্ঠ পত্নী ছান্দি বিবির সন্তান টিপু শাহ্ । 1813 সালে করিম শাহ্ ইন্তেকাল করেন।
1825 সালে শেরপর পরগণায় বিদ্রোহ শুরু হয়। সাবেক সুসঙ্গ পরগণার বর্তমান নেত্রকোনা জেলার পূর্বধলা উপজেলার লেটিকান্দা গ্রামে সোমেশ্বরী ও কংশের সন্নিকটবর্তী স্থান টিপুর জন্মভূমি। এখানেই টিপু শাহ ও তৎপিতা করিম শাহ্’র সমাধি অবস্থিত।
এই বিদ্রোহ পাগলপন্থী, ফকির বিদ্রোহ পাগলাইধুম নামে পরিচিতি লাভ করে। মূলত: ইহা ছিল সঞ্জীভূত কৃষক বিদ্রোহ। বিদ্রোহের অন্যতম কারণ 1820 সালে শেরপুরের জমিদারী চারভাগে বাটওয়ারা হয়ে গেলে জমিদারগণ প্রজার উপর অধিকহারে আবওয়াব, মাথট, খাজনা ধার্য করে।
ঐতিহাসিক মরিসনের রোজনামচা থেকে জানা যায় যে 1824 সালের 16 সেপ্টেম্বর শেরপুর জমিদারদের উপর ইঙ্গ-বর্মদেশ যুদ্ধের সৈন্য চলাচলের জন্য রাস্তা তৈরির হুকুম হয়। রাস্তা শেরপুর থেকে সুসঙ্গ হয়ে শ্রীহট্ট পর্যন্ত বিস্তৃত। হদি ও পাগলরা এই কাজ করতে চায় না। বেগার খাটার অভিযোগ ছিল। শেরপুরের হিন্দু, মুসলমান, গারো, হদি সকল প্রজা টিপু শাহ্-কে জমিদারদের অত্যাচার হতে রক্ষার আর্তি প্রকাশ করেন।
বকসু, দ্বীপচরণ সরকার, গুমানু সরকার, নহরদ্দি সরকার, আমেদ মন্ডল প্রধান প্রজাগণ শেরপুর সদর উপজেলাধীন কুটুরাকান্দাতে সভা আহ্বান করেন। টিপু শাহের নেতৃত্বে প্রায় সাতশত শিষ্য ও বহু প্রজা এই সভায় যোগদান করেন। পরবর্তীতে লেটেরকান্দায় এক বিরাট সভায় প্রজারা বলেন যে, “আপনার পূর্বপুরুষরা শেরপুরের শাসনকর্তা ছিলেন। বর্তমান সময়ে আপনাকে আমাদের সুলতান মনোনীত করলাম”।
সশস্ত্র পাগলদের মিছিল গোট পরগানায় ত্রাস সৃষ্টি করল। টিপু তার ধর্মমত জারী করল “সকল মানুষই ঈশ্বর সৃষ্ট সুতরাং কেহ কাহারো অধীন নহে। তাছাড়া জমির মালিক স্রষ্টা, কাজেই জমিদার খাজনা পাওয়ার হকদার না”।
জমিদার ও প্রজার যুদ্ধে শেরপুরে রক্তস্রোত প্রবাহিত হল। জমিদারগণ পলায়ন করে জয়েন্ট ম্যাজিস্ট্রেট ডেম্পিয়ার সাহেবের কাছারি বাড়ীতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। 19 জানুয়ারি শেরপুর থানার সন্নিকটে 7-8শত সশস্ত্র লোক চৈতনকাল্লা ও মদনকাল্লা সমবেত হয়ে জমিদারদের বাড়ি আক্রমণ করল, দু’জন বরকন্দাজ মেরে ফেলল এবং 4 জনকে বন্দী করে একমাস আটক করে রাখে। জমিদারী পাইকদের বিরুদ্ধে কৃষক ফৌজ গড়ে তোলা হয়। 24 জানুয়ারি গড়জরিপাতে তুর্ক শাহ্ ফকিরদের দলের সঙ্গে লড়াইয়ে দারোগা হেরে যায়।
বন্দরকাট গ্রামে 16 জানুয়ারি 1825 পাগলদের জবরদস্ত নেতা দুকু জোয়ারদারের নেতৃত্বে 150 থেকে 200 সশস্ত্র রায়ত জড়ো হয়ে বিদ্রোহ করে। বন্দরকাটার যুদ্ধে পুলিশের গুলিতে দুজন বিদ্রোহী মারা যান, দারোগা রণে ভঙ্গ দিয়ে পালিয়ে যায়। রায়তদের সশস্ত্র ফৌজে বর্শা, লাঠি ও কয়েকটি দেশি বন্দুকসমেত দেড় হাজার থেকে দুই হাজার বিদ্রোহী অংশ নেয়। টিপুর পাশাপাশি তাঁর মাও এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব ও অনুপ্রেরণা দেন। টিপু একটি স্বাধীন শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করেন। এ সম্পর্কে শেরপুরে জন্মগ্রহণকারী পন্ডিত মহামহোপাধ্যায় শ্রীযুক্ত চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার এর সংগৃহিত কবিতা প্রাসঙ্গিক:
“বকসু আদালত করে, দ্বীপচান ফৌজদার।
কালেকটরের সরবরাহকার গুমানু সরকার”।
অথ্যাৎ টিপু শাহের প্রশাসনে বকসু জজ, দ্বীপচান ফৌজদার, কালেকটরের সহকারী গুমানু সরকার।
ইংরেজেদের বিচারে টিপুর সাজা হয় এবং তিনি কারাবন্দী হন। আবার ইংরেজ জজ স্যারের স্ত্রীর সন্তান না হওয়ায় টিপুর নামে শিরনি দিয়ে সন্তান পান। তিনিও টিপুর ভক্ত হন। ইংরেজ সরকার টিপুকে ছেড়ে দেন।
টিপুর বাদশা কাছারি গড়ে উঠেছিল কালীগঞ্জ, লেটেরকান্দা, গড়জরিপা। কালিগঞ্জের শংকরপুরে করিমশাহে্র আদি আড্ডা ছিল, এখানকার তালুক তিনি পেয়েছিলেন। শংকরপুরে তৈরি করা হয় একরাশ নতুন বাড়ি যেখানে নতুন বাদশার নতুন রাজধানী গড়ে উঠে।
গুমানু সরকার ও উজির সরকার:
কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে বহু কৃষক নেতার জন্ম হয়েছে। টিপু শাহ্ যে আন্দোলন গড়ে তোলেন এক পর্যায়ে তার নেতৃত্ব দেন গুমানু সরকার। গুমানু সরকারের নিবাস ছিল গাজীর খামারে পরে তিনি সূর্যনগর গ্রামে বাস করতেন। এখানেই তার সমাধি আছে। তার বাড়ীতে 14-15 জন ভৃত্য ছিল, পরিবারে 100 জন লোক ছিল। কৃষকদের অপর নেতা উজির সরকার। তিনি বাস করতেন চাঁদের নন্নী গ্রামে। ভরতি সৌকানডির কৃষকরা ডানবারের আদেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে।
উজির সরকার ও গুমানু সরকার আইনী লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়ে ডানবারের বন্দোবস্তকে বাতিল করতে লাগলেন। তারা ময়মনসিংহের আদালতে অনেক আবেদন পেশ করে, মামলা দায়ের করেন। গুমানু সরকার তার আবেদন ঢাকার উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে নিয়ে গেলেন। গম্ভীর সরকারের নেতৃত্বে বিক্ষুব্ধ 300 রায়ত নিয়ে একটি সমাবেশ করেন। ডানবার গম্ভীর সরকারকে ধরে বেত মারেন।
1825-1832 সাল পর্যন্ত জমিদারদের বিরুদ্ধে এই কৃষক নেতারা 57টি মামলা পরিচালনা করেন। কলকাতা থেকে দেশীয় উকিল নিয়ে এসে মামলাগুলো পরিচালনা করা হয়। ডানবারের মতে শেরপুরের এই অধিবাসীরা অসভ্য, জংলি। এরা যেমন পাথর, ডালু, হাজং, কোচ। তাছাড়া বাঙ্গালীরাও আছে। সরকারি ভাবে এই বিদ্রোহী রায়তদেরকে পাগল বলে অভিহিত করা হয়েছে।
জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথর:
হদি সম্প্রদায়ের মাতব্বরদেরকে পাথর বলা হতো। নানকার প্রথায় নিষ্পেষিত হদি সম্প্রদায়ের কৃষকরা এই বিদ্রোহে নেতৃত্ব দেয়। গুমানু সরকার-উজির সরকারের পরে জানকু পাথর ও দোবরাজ পাথররা নেতৃত্ব পায়। আন্দোলন শুরু হয় মাথট ও অবওয়াবারের বিরুদ্ধে।
জানকু পাথর তার দলবল নিয়ে শ্রীবরদীর বাট্টাজোরে আড্ডা গড়েছিল । দোবরাজ পাথরের বিদ্রোহ নালিতাবাড়ী হালুয়াঘাট অঞ্চলে সীমাবদ্ধ ছিল। তাই 1833 সালে চৌধুরী জমিদারদের পরিবর্তে অন্তজ নেতৃত্ব চালায় রাজ্য। দশমাস ধরে এই রাজত্ব চলে। জানকু পাথরের সাথে তিন হাজার লোক ছিল। তারা তলোয়ার, বর্শা, ধনুক, বিষতীর ও গাদা বন্দুকে সজ্জিত ছিল। তারা রায়তদের কাছ থেকে কর সংগ্রহ করেছে। তাদের মূল উদ্দেশ্য ছিল পাহাড় এলাকার নিয়ন্ত্রণ রেখে শেরপুর শহর দখল, সদর থানা দখল, ধনী জমিদারদেরকে নিয়ন্ত্রণে আনা। ডানবার সাহেব তার রোজনামচায় 11টি লুঠতরাজ ও হিংসাত্মক ব্যবহারের কথা উল্লেখ করেন।
একবার নালিতাবাড়ী থেকে দোবরাজ পাথর জমিদার, পুলিশ, বরকন্দাজ ও মুহুরীকে ধরে নিয়ে যায়। জানকু পাথর ঘোষণা করেন “তার কর্তৃত্ব ছাড়া শেরপুর পরগণা আর কারো কথায় চলবে না”।
29 এপ্রিল, ডানবার সাহেব জামালপুর থেকে 150 জন সশস্ত্র সৈন্য চেয়ে পাঠান। সেনা বাহিনী দু’ভাগে বিভক্ত করা হয়। ক্যাপ্টেন সীলের নেতৃত্বে 1লা মে একদল সৈন্য প্রস্তুত হয়ে পশ্চিম দিকে বাট্টাজোরে অভিযান চালায়। অন্যদল ইয়ংহাজব্যান্ডের নেতৃত্বে পূর্ব দিকে অভিযানে যায়। বাট্টাজোরে জানকু পাথর 60টি বন্দুকের আওয়াজ তোলেন। ফলে ক্যাপ্টেন সীল আক্রমণ করলেন না। 3 মে ইয়ংহাজব্যান্ড ও সীল মধুপুরে মিলিত হয়ে জানকুর বাসস্থান জলঙ্গী আক্রমণ করল।
7মে ইয়ংহাজব্যান্ড নালিতাবাড়ী ও হালুয়াঘাট অবস্থানে দোবরাজ পাথরের নির্মিত দুর্গের অনুসন্ধান চালায়। পথিমধ্যে পাগলদের সাথে সংঘর্ষ হয় এবং দোবরাজ পাথরের সুরক্ষিত বাড়ী খুজে পান। দোবরাজের বাড়ী আগুন লাগিয়ে সম্পূর্ণভাবে পুড়ে ফেলা হয়। তার বাড়ী থেকে বন্দী একজন পুলিশ, জমাদার, মুহুরি, বরকন্দাজ, পিওন ও গ্রামের ইজারাদারকে উদ্ধার করা হয়। বিদ্রোহ শেষ হয় দোবরাজ পাহাড়ে চলে যায়। জানকু শেষ জীবনে তহশীলদারের চাকুরী নেয়।
যে সব গ্রন্থ থেকে তথ্য সংগ্রহ করা হয়েছে:
- ময়মনসিংহের ইতিহাস ও ময়মনসিংহের বিবরণ-কেদারনাথ মজুমদার
- ইমাম ও নিশান-বাংলার কৃষক চৈতন্যের এক অধ্যায়-গৌতম ভদ্র
- নাগ বংশের ইতিহাস-শ্রী বিজয়চন্দ্র নাগ
- সেরপুর বিবরণ-হরচন্দ্র চৌধুরী
(লেখাটি সংক্ষিপ্ত আকারে লিপিবদ্ধ করা হলো, কলেবর না বাড়ানোর জন্য অনেক তথ্য সন্নিবেশ করা সম্ভব হল না। পরবর্তীতে বিস্তারিত তথ্য নিয়ে বই আকারে প্রকাশ করা হবে-লেখক)
লেখক: কবি, লেখক ও গবেষক, সিনিয়র সচিব (অব:), চেয়ারম্যান গেøাবাল সাসটেইনেবল টুরিজম নেটওয়ার্ক বাংলাদেশ