/তুরস্কের ‘সিটি অফ প্রফেটস’

তুরস্কের ‘সিটি অফ প্রফেটস’

শানলিউরফা, বা উরফা, ধর্মীয় গুরুত্বের কারণে আগে থেকেই পরিচিত ছিল, বিশেষভাবে এই জায়গাকে নবীদের শহর বা ‘সিটি অফ প্রফেটসও’ বলা হয়। উরফা-র বিস্ময়কর ঐতিহাসিক স্থানগুলো ভ্রমণের অভিজ্ঞতা যেকোনো পর্যটকের জন্য এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি। ১৯১৯ সালে ফরাসি সৈন্যদের বিরুদ্ধে উরফার বীরত্বপূর্ণ প্রতিরোধকে সম্মান জানাতে, তুর্কি গ্র্যান্ড ন্যাশনাল অ্যাসেম্বলি (ঞএঘঅ) ১৯৮৪ সালে একটি আইন পাস করে যা এটিকে “ধহষı” (তুর্কি ভাষায় যার অর্থ গৌরবময়) উপাধিতে ভূষিত করে, ফলে এটিকে এখন বলা হয় শানলিউরফা।

ইতিহাসে প্রাচীনতম মন্দির গোবেকলিতেপে-র (এস্খনবশষরঃবঢ়ব) আবিষ্কার, উরফার আন্তর্জাতিক খ্যাতি বাড়িয়ে দিয়েছে। ২০১৯ সালের তুর্কি টিভি সিরিজ, ‘আতিয়ে’ (অঃরুব) প্রচারিত হয়, যার মূল বিষয়বন্তু ছিলো গোবেকলিতেপে, বিপুল জনপ্রিয়তা পাওয়া এই টিভি সিরিজের কল্যাণে উরফার প্রতি বিশ্বব্যাপী আগ্রহ প্রবল আকার ধারণ করে।

উরফা: অতীত থেকে বর্তমান

১২,০০০ বছরেরও বেশি পুরনো ইতিহাস সমৃদ্ধ উরফা আনাতোলিয়ার প্রাচীনতম অ লগুলোর মধ্যে একটি। প্রাগৈতিহাসিককাল থেকেই উরফা বহু শতাব্দী ধরে অগুণিত সাম্রাজ্য, রাজা এবং শাসকদের বসবাসের স্থান ছিলো, সেই রোমান থেকে সেলজুকস, আইয়ুবি রাজবংশ থেকে অটোমান এবং উমাইয়া খিলাফত থেকে এডেসা কাউন্টি পর্যন্ত (ক্রুসেডার রাজ্যগুলির মধ্যে একটি)। ইতিহাসের অনেক বিশিষ্ট পূর্বপুরুষগণ এখান থেকে যুদ্ধ পরিচালনা করেছিলেন, ধর্মযুদ্ধ বা ক্রুসেড সংগঠিত করেছিলেন, কেউকেউ শহরগুলি বিনির্মাণ করেছিলেন; বাণিজ্যরুট এবং বিনিয়োগের জন্য এইস্থান বহুভাবে ববহৃত হয়ে এসেছে। তবে এই অ লে সবচেয়ে যুগান্তকারী প্রত্নতাত্তিক আবিষ্কার নিঃসন্দেহে গোবেকলিতেপে (এস্খনবশষরঃবঢ়ব)।

শানলিউরফা প্রত্নতত্ত জাদুঘর

শানলিউরফা প্রতœতত্ত¡ জাদুঘর পরিদর্শনের মাধ্যমে আমি আমার একদিনের ট্রিপ শুরু করেছি। উল্লেখ্য, প্রদর্শনী এলাকার আকারের পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমানে এটি তুরস্কের বৃহত্তম জাদুঘর। বিভিন্ন যুগের ১০,০০০ এরও বেশি নিদর্শন এই জাদুঘরে প্রদর্শিত রয়েছে। এই জাদুঘরটিকে একটি একক ভবন না বলে এটিকে একটি কমপ্লেক্সরূপে উপস্থাপন করলে বুঝতে সুবিধা হবে। এখানে রয়েছে ১৪টি প্রদর্শনী হল এবং ৩৩টি অ্যানিমেশন এলাকা। এগুলোর মাধ্যমে বেশ কয়েকটি সময়কালকে ধরে এই অ লের বিস্তৃত ইতিহাস চিত্তাকর্ষকভাবে তুলে ধরা হয়। উপরন্তু, ইতিহাসের বিভিন্ন সময়কালের বাড়িগুলোর স্থাপত্যশৈলী কেমন ছিলো সেগুলোও প্রামাণ্য ও উপভোগ্যভাবে দর্শকদের জন্য উপস্থাপন করা হয়।

জাদুঘরে আরেকটি মনোমুগ্ধকর এবং বিস্ময়কর শিল্পকর্ম হল পৃথিবীর সবচেয়ে প্রাচীন এবং বিশাল মানবমূর্তি বালিক্লিগল মূর্তি  (ঃযব ইধষıশষıমস্খষ ংঃধঃঁব) বা উরফাম্যান। এখানকার আরেকটি বিশেষত্ব হচ্ছে গোবেকলিতেপে (এস্খনবশষরঃবঢ়ব)  মন্দিরের নির্মিত দৃষ্টিনন্দন প্রতিরূপ। এই জায়গাটিই সত্যি অসাধারণ মুগ্ধকর এবং ভাবনারও বিষয় যে, প্রাগৈতিহাসিক মানুষরা কীভাবে এত বিশাল পাথরের খন্ডকে আকৃতি দিয়েছিলো, কেমন করে এগুলো সেইসময়ে বহন করে এনেছিলো, কারণ এর কোনোকোনোটির ওজন ৬০ টন বা ৬০ হাজার কেজি।

প্রদর্শনী হলের অভ্যন্তরভাগসহ এই বিশাল বিল্ডিংয়ের সম্মুখ অংশ সমসাময়িক এবং জাকজমকপূর্ণ নকশায় অঙ্কিত। একই টিকেটে পাশের সংলগ্ন হালেপ্লিবাচে মোজাইক জাদুঘরও দেখা যায়। উভয় জাদুঘরই ১ এপ্রিল থেকে ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত সকাল ১০টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত পরিদর্শন করা যায় এবং ১৫ নভেম্বর থেকে ১ এপ্রিলের আগের সময়কাল সকাল ৮ টা থেকে বিকাল ৫ টা পর্যন্ত। শানলিউরফা জাদুঘর প্রতিদিন খোলা থাকে, হালেপ্লিবাচে মোজাইক যাদুঘর সোমবার বন্ধ থাকে।

হালেপ্লিবাচে মোজাইক জাদুঘর

হালেপ্লিবাচে মোজাইক জাদুঘরে মূলত অক্ষত মোজাইকগুলো প্রদর্শিত রয়েছে যা নির্মাণ কাজের সময় আবিষ্কৃত একটি প্রাচীন রোমান ভিলার ভিত্তি তৈরিতে ব্যবহৃত। পরবর্তীকালে, ভিলা যেখানে ছিল তার অবশিষ্টাংশের ঠিক উপরে একটি জাদুঘর তৈরি করা হয়েছিল এবং মোজাইকগুলো ইন-সিটু (তাদের আসল জায়গায়) প্রদর্শিত রয়েছে। এই প্রাচীন রোমান ভিলাটিকে ‘অ্যামাজনের ভিলা’ও বলা হয়। জাদুঘরটিতে মোজাইকগুলোর উপরে একটি বৃত্তাকার পথ তৈরি করা হয়েছে যাতে মোজাইক ফ্লোরের প্রতিটি কোণ দর্শকদের জন্য দেখতে সহজ হয়।

কিজিল কোয়ুুন নেক্রোপলিস

সানলিউরফা প্রত্নতত্ জাদুঘর কমপ্লেক্সের পূর্বদিকে এটি অবস্থিত, এই রহস্যময় নেক্রোপলিসটি অবাককর লেগেছে এজন্য যে এটি ভ্রমণ গাইড বা মানচিত্রে উল্লেখ ছিলোনা। একটি দীর্ঘ পাথরের ভেতরে খোদাই করা এই নেক্রোপলিসটি রোমানদের দ্বারা নির্মিত এবং এটি ব্যবহার করা  হয়েছিলো সম্ভবত খ্রিস্টীয় তৃতীয় এবং চতুর্থ শতাব্দীর মাঝামাঝি। 

বালিক্লিগল

বালিক্লিগল যা ইবরাহিমের পুল বা হালিল-উর রহমান লেক নামেও পরিচিত। ১৫০-মিটার বা ৪৯২-ফুট-লম্বা পবিত্র এই পুকুরটি উরফার কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত। এই পুকুরটি এবং এতে থাকা হাজারহাজার কার্প মাছ ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। কিংবদন্তী রয়েছে, হযরত ইবরাহিম আ. রাজা নমরূদকে চ্যালেঞ্জ করেছিলেন এবং রাজার মূর্তিপূজা তথা বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন; ইবরাহিম আ. ঘোষণা করে বলেছিলেন যে, সৃষ্টিকর্তা একজন, তিনি আল্লাাহ্। নমরূদের জন্য চূড়ান্ত মুশকিল ডেকে এনেছিলো যখন তার কন্যা হযরত ইবরাহিমের আহবানে সাড়া দিয়ে নিজেকে সমর্পিত করেছিলেন। এতে ক্ষুব্ধ হয়ে রাজা নমরূদ একটি বিশাল অগ্নিকুন্ড জ্বালানোর নির্দেশ দেন এবং হযরত ইব্রাহিম আ.-কে তাতে নিক্ষেপ করে মৃত্যুদন্ড কার্যকর করার আদেশ করে। যখন তাঁকে অগ্নিশিখায় নিক্ষেপ করা হয়েছিল, সৃষ্টিকর্তা বললেন: “হে আগুন, ইবরাহিমের প্রতি শান্তিদায়ক শীতল হয়ে যাও।” অলৌকিকভাবে, আগুন জলে পরিণত হয়েছিল এবং অগ্নিকূপের কাঠের টুকরোগুলো কার্প মাছে পরিণত হয়েছিল।

বালিক্লিগল এবং এটি যে পার্কে অবস্থিত সেই জায়গাটি খুব প্রশান্তিময় এবং টিপটপভাবে গোছানো। ঘুরে বেড়ানার জন্য এটি এক মনোরম লেক। এরমধ্যে থাকা পবিত্র মাছগুলো সম্ভবত বিশ্বের সবচেয়ে সুবিধাপ্রাপ্ত প্রাণীদের মধ্যে অন্যতম। স্ফটিক স্বচ্ছ জলে প্রতিদিন প্রচুর পরিমাণে খাদ্য তাদের জন্য সরবরাহ করা হয়। 

আয়ন জেলিহা লেক

আয়ন জেলিহা হ্রদ বালিক্লিগোলের কাছে অবস্থিত এবং পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে, রাজা নমরূদের কন্যা জেলিহার চোখের জল থেকে এটি সৃষ্টি হয়েছে, যিনি তার প্রিয় ইব্রাহিমকে আগুনে নিক্ষেপের দৃশ্য দেখে সহ্য করতে পারেননি।

সামান্য ভিন্ন আরেকটি বিবরণ অনুসারে, জেলিহাও ইবরাহিম আ.-কে আগুনে নিক্ষিপ্ত হতে দেখে নিজেকে আগুনে নিক্ষেপ করেছিলেন। যে জায়গাটিতে তিনি নিজের জীবন দিয়েছিলেন সেটিই এখন আয়ন জেলিহা লেক।

শানলিউরফা দুর্গ

শানলিউরফা ক্যাসেল বা দুর্গ থেকে গোটা শহরকে সবচেয়ে সুন্দরভাবে দেখা যায়। যদিও চলমান খনন এবং পুনরুদ্ধার কাজের কারণে দুর্গটি বর্তমানে বন্ধ রয়েছে। দুর্গের গেটের কাছ থেকে শহরের সুন্দর ছবি তোলার বিষয়টিও বেশ চমৎকার।

দেরগাহ মসজিদ, যে গুহায় নবী ইব্রাহিমের জন্ম হয়েছিল 

উরফা-র আরেকটি পবিত্রস্থান যা ইসলামে গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব ফেলে তা হলো হযরত ইবরাহিম আ. যে গুহায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন সেটি দেরগাহ মসজিদ কমপ্লেক্সের মধ্যে রয়েছে বলে মনে করা হয়। গুহায় বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়, কোনো টিকেটের প্রয়োজন নেই। তবে মসজিদ এবং গুহার রক্ষণাবেক্ষণে কেউ অবদান রাখতে চাইলে এখানে যেকোনও পরিমাণ দান, ইচ্ছা করলে কেউ করতে পারেন।

গুহাটি আংশিকভাবে প্লাবিত হয়ে একটি জলের ধারা বয়ে গেছে, স্থানীয়দের কাছে জলের এই উৎসটিকে জমজম কূপের পরে পবিত্রতম জলধারা বলে মনে করা হয়।

রন্ধনশিল্পের জাদুঘর

আচ্ছাদিত বাজারের সরু গলির চারপাশে ঘোরাঘুরি করে আমি একটি আকর্ষণীয় জায়গায় এসে থমকে গেলাম; এটি একটি জাদুঘর, রন্ধনশিল্পের জাদুঘর। একটি ঐতিহাসিক প্রাসাদে এটি নির্মিত, আকারে ছোট হলেও বৈশিষ্টের ক্ষেত্রে অনন্য। উরফার রন্ধনপ্রণালী সম্পর্কে অত্যন্ত তথ্যপূর্ণ প্রদর্শনী রয়েছে এই জাদুঘরে। এখানে বিনামূল্যে প্রবেশ করা যায়, তুরস্কের উরফা ভ্রমণে এটি একটি ‘মাস্ট সি’।

রান্নার যাদুঘরে একটি প্রদর্শনী।

যদিও বেশিরভাগ মানুষই উরফাকে গোবেকলিতেপে-র সাথে যুক্ত করে, আসলে শহরটি নিজেই বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন এক জনপদ। যদিও এখানে অনেক পর্যটকের দেখা মিলবেনা, কিন্তু সত্যি এটি এক অতুলনীয় শহর যেখানে অনেককিছু দেখার আছে। 

 লেখক: আরগুন কনুক, সংবাদকর্মী, দৈনিক সাবাহ