প্রেতাত্মা বা অশরীরি আত্মা এই শব্দগুলো আমাদের খুবই পরিচিত। গভীর রাত, স্তব্ধ চারপাশ, আকাশে মেঘ, কোন আলো নেই, হঠাৎ কুকুরের কান্না এর মাঝে অন্ধকার ভেদ করে সাদা কাপড় পরে কেউ আপনার সামনে দিয়ে চলে গেল কিংবা শিশুকণ্ঠের কান্নার আওয়াজ এলো..। তখন আপনাকে কি অবস্থায় পাওয়া যাবে? এমন অনেক ব্যাখ্যাতীত ঘটনা আমাদের সাথেই ঘটে, ঘটছে। পৃথিবীর বহু বিখ্যাত শহরের মতো ঢাকাতেও রয়েছে এমনি কিছু রহস্যময় স্থান ও স্থাপনা। সময়ের ব্যবধানে এই শহরের অনেক পরিবর্তন-পরিবর্ধন হলেও সেই বিষয়গুলো এখনও বিরাজমান। ঢাকার এমনি কিছু কাহিনী তুলে ধরা হলো:
লালবাগ কেল্লা
১. লালবাগ কেল্লা ঢাকার প্রাচীন ঐতিহাসিক দর্শনীয় স্থানগুলোর একটি। লালবাগ কেল্লা সাধারণ সময়ে মানুষের কাছে যতটা না আকর্ষণীয়; পূর্ণিমার রাতে সমাধি থেকে উঠে আসা পরীবিবির আনন্দ-উল্লাস, গান আর নাচ ততটাই রহস্যময়।
মোগল সম্রাট আওরঙ্গজেবের তৃতীয়পুত্র সুবেদার মোহাম্মদ আজম শাহ বুড়িগঙ্গা নদীর তীরে এই দুর্গের নির্মাণ কাজ শুরু করেন। যদিও কাজ শেষ করার আগেই সম্রাটের ডাকে তিনি দিল্লি ফিরে যান। পরবর্তীতে শাসক শায়েস্তা খাঁর আমলে কেল্লার কাজ সম্পন্ন হয়। শায়েস্তা খাঁ ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা শাসন করেন। তার সময়কালে টাকায় আট মণ চাল পাওয়া যেত বলে ইতিহাসে উল্লেখ রয়েছে।
১৬৮৪ সালে শায়েস্তা খাঁর অতি আদরের কন্যা ইরান দুখত যিনি পরীবিবি নামে বিখ্যাত এই লালবাগ দুর্গে মৃত্যুবরণ করেন। কন্যাশোকগ্রস্ত শায়েস্তা খাঁ কেল্লাপ্রাঙ্গণেই মাজার নির্মাণ করেন। লালবাগ কেল্লার প্রধান তিনটি স্থাপনা হচ্ছে মসজিদ, দেওয়ান-ই-আম এবং পরীবিবির মাজার। ঐতিহাসিকভাবে এই মাজারকে কেন্দ্র করে নানারকম কাহিনী প্রচলিত আছে। কথিত আছে, ভরা পূর্ণিমার নির্জন গভীর রাতে শিশু পরীবিবি তার সমাধি থেকে উঠে আসেন। জোৎনা রাতের নরম মায়াবি আলোতে কেল্লার খোলা জায়গায় পরীবিবি খেলাধুলা করেন,গান গান,নাচেন। স্থানীয় অধিবাসীদের অনেকেই তার শিশুকণ্ঠের গান এবং নৃত্যের ছন্দ এখনও শুনতে পান। ছায়া দেখেন।
২. লালবাগ দুর্গে আরেকটি ঘটনা প্রতিদিনই ঘটে। গভীর রাতে এক ব্যক্তি ঘোড়ায় চড়ে আসেন। মসজিদে ঢুকে তিনি প্রার্থনায় মশগুল হন। তার আগমন এবং নামাজ পড়ার বিষয়টি পরিষ্কারভাবে বোঝা যায়। তিলাওয়াতের শব্দ শোনা যায় বলে স্থানীয় অনেকেই উল্লেখ করেছেন। কৌতূহলী হয়ে কেউ কেউ ভেতরে দেখারও চেষ্টা করেছেন। কিছু বিশেষ সময়ে সেই পবিত্র আত্মাকে অনেকেই দেখতে পান। মস্তকহীন ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে তিনি আসেন, মসজিদে নামাজ আদায় করে আবার চলে যান, সেই ছায়া স্পষ্ট দেখা যায়।
আজ ভুতুড়ে কাহিনী হিসেবে ঢাকার লালবাগ কেল্লার এই ঘটনা দুটি মানুষের মুখে মুখে ফেরে।
ঢাকা এয়ারপোর্ট রোড
হিথরো এয়ারপোর্ট থেকে লন্ডন শহরে ঢোকার পথে বছরে ১০ জনের বেশি টুরিস্ট ভূতের আক্রমণে মারা যান। এগুলো নিয়ে প্রচুর রেকর্ডেড স্টোরি রয়েছে। পাঠক হয়তো জেনে অবাক হবেন, ঢাকা এয়ারপোর্ট রোডেও ভূত রয়েছে। কিছুকাল আগেও এই রোডে অসংখ্য দুর্ঘটনা এবং মৃত্যুর সংবাদ পত্রিকার শিরোনাম হতো। জনশ্রুতি রয়েছে, এর পেছনে মূল কারণ হচ্ছে, সেসব ভূতের আক্রমণ। এখনও এই ভূতের উৎপাত চালু আছে, তবে পরিধি কমেছে। মূলত নিকুঞ্জ থেকে বিমানের বলাকা অফিস পর্যন্ত জায়গাতে এই ভূত রাতের বেলা মানুষকে আক্রমণ করে। বিশেষভাবে যারা রাতে গাড়ি চালান তাদের অনেককেই এর শিকার হতে হয়েছে। এই ভূত নারীর রূপ ধরে থাকে। রাতের বেলা ফাঁকা রাস্তায় হঠাৎ সে গাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে পড়ে। অপ্রস্তুত চালক তখন বিপদ এড়ানোর জন্য আকস্মিক ব্রেক করতে যেয়ে দুর্ঘটনায় পতিত হন। অনেকেই মনে করেন, এই রোডে দুর্ঘটনায় নিহত প্রেতাত্মারাই এই ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে। ভুক্তভোগী অনেকেই ঘটনা স্বীকার করে রাতে একা গাড়ি চালানোর ক্ষেত্রে বিশেষ সতর্কতা অবলম্বন করার পরামর্শ দিয়েছেন। বিশেষভাবে নিকুঞ্জ থেকে বিমান অফিস পর্যন্ত পথটুকু পাড়ি দেওয়ার সময় গান শোনা বা মোবাইলে কথা বলা থেকে বিরত থাকা ভালো।
ঢাকা গলফ হেইটস বনানী
ঢাকার অভিজাত এলাকা বনানী গোরস্থানের পাশেই অবস্থিত ঢাকা গলফ হেইটস। অশরীরি এবং প্রেতাত্মাদের উৎপাত নিয়ে এখানে অসংখ্য কাহিনী প্রচলিত আছে দির্ঘকাল থেকে। মধ্যরাতে একটি শিশু কবরস্থানের ভেতর চিৎকার করে কাঁদতে থাকে। কখনো কখনো কটু দুর্গন্ধ ছড়িয়ে যায় আশেপাশে। ঢাকায় থাকেন এমন অনেকেই স্বীকার করেছেন ঘটনার সত্যতা। অতি উৎসাহি কেউ কেউ রাতের বেলা গোরস্থানের ভেতরে শিশুকান্নার উৎস খোঁজার চেষ্টা করেছেন। অশরীরি কান্নার শব্দ বা গন্ধ পাওয়া গেলেও তাকে দেখতে পাওয়া যায়নি। অশরীরি আত্মারা নারী বা শিশুররূপে এই সমস্ত কর্মকান্ড ঘটানোর কারণ হলো সাধারণভাবে মানুষ নারী বা শিশুর প্রতি দুর্বল থাকে। এই সমস্ত আত্মা ভালোমন্দ দুইরকমই হতে পারে। এজন্য অশরীরিদের চলাচলের জায়গায় কখনো সুঘ্রান কখনো বা কটু গন্ধ ছড়িয়ে পড়ে।
পূর্ব নয়াটোলা রেলক্রসিং
ঢাকার পূর্বনয়াটোলা রেলক্রসিং-এ হঠাৎ হঠাৎ রহস্যময় এক নারীকে দেখা যায়। সে রেললাইন ধরে হাটতে থাকে যেন কাউকে খুজছে। অন্যকিছুতে তার ভ্রমন নেই। নানা রূপে সে আবির্ভূত হয়। মানুষের দৃষ্টি আকৃষ্ট হওয়ামাত্র রহস্যনারী চোখের পলকে হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। যারা তাকে দেখেছেন তাদের অনেকেই বলেছেন এটা রীতিমত গাঁ হিম করা এক দৃশ্য। একটা মানুষ কিভাবে নিমিষেই শূণ্যে মিলিয়ে যেতে পারে তা দেখা এক কথায় ভীতিকর। স্থানীয় ষ্টেশন মাষ্টার জানান এটা সম্ভবত কোন অপআত্মার কেউ। লোকমুখে প্রচলিত এই নারীরূপী অশরীরি আত্মা তার বাচ্চাকে খোঁজার জন্য রেললাইন ধরে হাটতে থাকে। কেউ কেউ মনে করেন কোনো মা এবং তার শিশুসন্তান এই রেললাইনে কাটা পড়েছিলো। অনেকেই এই হাওয়া হয়ে যাওয়া নারীকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে ব্যার্থ হয়েছেন। ভিতিসারিত হওয়া ছাড়া রহস্যের কোনো কিনারা আজেও করতে পারেননি।
খালিদ মুহাইমিন