মেডিকেল ট্যুরিজমে ইরানের নজরকাড়া সাফল্য

মেডিকেল ট্যুরিজমে ইরানের নজরকাড়া সাফল্য
সাইদুল ইসলাম

২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৬৪টি দেশ থেকে বছরে প্রায় ১২ লাখ রোগী মেডিক্যাল ট্যুরিজমের লক্ষ্যে ইরান সফরে আসছেন এবং ইরানের উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকেও আকৃষ্ট করছে। জাতিসংঘের পর্যটন বিষয়ক মহাসচিব জুরাব পোলোলিকাশভিলি গত ৩ মার্চ ২০২৫ পর্যটন শিল্পে টেকসই উন্নয়নে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন।

মেডিকেল ট্যুরিজম বা স্বাস্থ্য পর্যটন হলো একটি আধুনিক ও উদীয়মান পর্যটন ধারণা, যা সাম্প্রতিক সময়ে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছেছে। এর মূল কারণ হলো, মানুষ এখন নিজের এবং পরিবারের স্বাস্থ্যের প্রতি বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। স্বাস্থ্য পর্যটনে মূলত ব্যক্তি তার স্বাস্থ্য ও সুস্থতা নিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে নির্দিষ্ট কোনো স্থানে ভ্রমণ করে, যেখানে চিকিৎসা সেবার পাশাপাশি সুস্থ বিনোদনের সুযোগ রয়েছে।

স্বাস্থ্য পর্যটনের দুইটি প্রধান দিক রয়েছে। একটি হলো প্রাকৃতিক আকর্ষণ এবং অপরটি হলো প্রযুক্তিগত ও শিল্প আকর্ষণ, যা একটি দেশের চিকিৎসা এবং থেরাপিউটিক সক্ষমতা ও সুবিধার ওপর বিশেষভাবে গুরুত্ব দেয়। এই পর্যটনের ক্ষেত্রে ইরান মধ্যপ্রাচ্যে আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে ভরপুর এই দেশটিতে উন্নত চিকিৎসা কেন্দ্র এবং দক্ষ ও অভিজ্ঞ ডাক্তারদের কারণে ইরানকে এই অঞ্চলের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্বাস্থ্য পর্যটন গন্তব্য হিসেবে বিবেচনা করা হয়। চিকিৎসা সেবা গ্রহণের জন্য ইরান ভ্রমণের একটি প্রধান কারণ হলো এখানকার প্রায় সকল চিকিৎসার খরচ বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। অতীতে, উন্নয়নশীল দেশগুলোর লোকেরা উন্নত স্বাস্থ্যসেবা পেতে উন্নত দেশগুলোতে ভ্রমণ করতো। থেরাপিউটিক ভ্রমণ ধারণার কল্যাণে ভ্রমণপিপাসুরা নিজ দেশের তুলনায় কম খরচে উচ্চমানের স্বাস্থ্যসেবা পেতে ভ্রমণ করেন।

১৯৭৯ সালে ইসলামি বিপ্লবের বিজয়ের পর থেকেই জ্ঞান-বিজ্ঞানে ধাপেধাপে এগিয়ে চলেছে ইরান। বিশেষ করে চিকিৎসাবিজ্ঞানে গত ৪৬ বছরে দেশটির সাফল্য চোখে পড়ার মতো। বিপ্লবের আগে যে দেশটির অনেক শহরে ইরানি ডাক্তার খুঁজে পাওয়া দুরূহ ব্যাপার ছিল সেই ইরানের নাম এখন চিকিৎসাবিজ্ঞানে বিশ্বের শীর্ষ দেশগুলোর তালিকায় অন্তর্ভুক্ত। ২০২৩ সালের নভেম্বরে প্রকাশিত ইসলামিক ওয়ার্ল্ড সায়েন্স সাইটেশন (আইএসসি) ইনস্টিটিউটের  প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের সর্বাধিক আলোচিত বিজ্ঞানীদের শীর্ষ এক শতাংশ গবেষকের মধ্যে স্থান পেয়েছেন ৯ শতাধিক ইরানি গবেষক যার ৪৮ শতাংশই চিকিৎসাবিজ্ঞান বিষয়ক গবেষক। চিকিৎসা নীতিশাস্ত্রের গবেষণার ক্ষেত্রে শীর্ষ অবস্থানে রয়েছে ইরান। চিকিৎসা নীতিশাস্ত্র স্বাস্থ্য পর্যটনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ দিক। আর স্বাস্থ্য পর্যটনের বিষয়টিকে বিশেষ বিবেচনায় এনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান তার পর্যটন শিল্পকে বিশেষভাবে ঢেলে সাজাচ্ছে।

বার্তা সংস্থা ইরনার এক রিপোর্টে বলা হয়েছে, ইরান বিশ্বের শীর্ষ ১০টি ওষুধ উৎপাদনকারী দেশের একটি। ওষুধ উৎপাদন এবং ক্যান্সারসহ বিভিন্ন জটিল রোগের চিকিৎসায় ইরান ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে। ইরানের প্রয়োজনীয় ওষুধের প্রায় ৯৯ শতাংশই দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করছে। ইরান এখন মধ্যপ্রাচ্যের অন্যতম সফল ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হয়েছে। চলতি ইরানি বছরের প্রথমার্ধে ১০৪ দশমিক ৬ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের ওষুধ রপ্তানি করেছে। যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৯ দশমিক ৭ শতাংশ বেশি।

ইরান ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (আইএফডিএ) জানিয়েছে, দেশটি বিশ্বের প্রায় ৫০টি দেশে কাঁচামাল এবং ওষুধ পণ্য রপ্তানি করে। আইএফডিএ-এর রপ্তানি নীতি নির্ধারণী কাউন্সিলের সচিব বলেছেন, প্রায় ১০০টি কোম্পানি ইরানের কাঁচামাল এবং ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্য প্রায় ৫০টি গন্তব্যে রপ্তানি করে। ইরানি কোম্পানিগুলোর অভ্যন্তরীণ চাহিদা মেটানোর পাশাপাশি কয়েকগুণ বেশি ওষুধ উৎপাদনের সক্ষমতা রয়েছে বলে জানান তিনি। দেশটি বর্তমানে ইউরোপ, এশিয়া এবং দক্ষিণ আমেরিকার দেশগুলোসহ ৬৩টি দেশে চিকিৎসা সরঞ্জাম রপ্তানি করছে। ইরানের খাদ্য ও ওষুধ প্রশাসনের মেডিক্যাল ইকুইপমেন্ট অ্যাফেয়ার্স এ তথ্য জানিয়েছে।

গতবছর ইরানের একটি জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি পাঁচটি মহাদেশের ৫০টি দেশে ১৭ হাজারের অধিক উন্নত চিকিৎসা ডিভাইস রপ্তানি ও ইনস্টল করেছে। রোগীর অত্যাবশ্যক লক্ষণ মনিটর, উন্নত আইসিইউ ভেন্টিলেটর, ইলেক্ট্রোকার্ডিওগ্রাফ, এইডি ডিফিব্রিলেটর এবং সাকশন ডিভাইসসহ উন্নত চিকিৎসা সরঞ্জামের নকশা ও উৎপাদনে কোম্পানিটির বিশেষত্ব রয়েছে।

মেডিকেল ট্যুরিজমের অন্যতম প্রধান বিবেচ্য বিষয় হলো হাসপাতাল। আর হাসপাতাল নির্মাণে বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ ইরান। দেশটির শহিদ বেহেশতি ইউনিভার্সিটি অফ মেডিক্যাল সায়েন্সেসের চ্যান্সেলর ড. অধ্যাপক আলীরেজা জলি জানিয়েছেন, হাসপাতাল নির্মাণ, সজ্জিতকরণ এবং সংস্কারের ক্ষেত্রে ইরানের ব্যবস্থাপনা খুব উন্নতমানের। তিনি বলেন, হাসপাতাল নির্মাণের ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের অন্যতম শীর্ষস্থানীয় দেশ। এক্ষেত্রে ইরানি প্রকৌশলীদের উচ্চ প্রযুক্তিগত জ্ঞান ও দক্ষতা রয়েছে। ইরানে প্রায় ১,১০০টি উন্নত হাসপাতাল রয়েছে, যার ৭০% সরকারি হাসপাতাল। ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, হস্তশিল্প ও পর্যটন মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বর্তমানে ইরাক, আফগানিস্তান, পাকিস্তান, আর্মেনিয়া, তাজিকিস্তান, ওমান ও বাহরাইনসহ দক্ষিণ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর নাগরিকরা চিকিৎসাসেবা নিতে নিয়মিত ইরান সফরে আসছেন। উল্লেখ্য, ইরানের হাসপাতালগুলোতে ব্যবহৃত প্রায় ৯০ শতাংশ চিকিৎসা সরঞ্জাম দেশীয়ভাবে তৈরি করা হয়। গত বছরের ১২ মে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তা আহমেদ মোসলেমি জানান, পরিমাণ ও বৈচিত্র্য উভয় দিক থেকেই চিকিৎসা সরঞ্জাম উৎপাদনে ইরান পশ্চিম এশিয়ায় প্রথম স্থান অধিকার করেছে। দেশটি চিকিৎসাবিজ্ঞানের আরো অনেক শাখায় ব্যাপক সাফল্য অর্জন করেছে যার কয়েকটি দিক নিচে তুলে ধরা হলো।

ভেষজ এবং ঐতিহ্যবাহী ওষুধ উৎপাদনে ইরান বিশ্বে চতুর্থ

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের ভেষজ ও ঐতিহ্যবাহী ওষুধ বিভাগের সচিব মোহাম্মদ রেজা শামস আরদাকানি বলেছেন, ইরানি গবেষকরা ভেষজ ও ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ক্ষেত্রে জ্ঞান উৎপাদনে বিশ্বে চতুর্থ স্থান অর্জন করেছে। ভেষজ ও ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা পদ্ধতি ব্যবহারে ইরানের কয়েক হাজার বছরের রেকর্ডের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, ২০০৭ সালে ভেষজ ও ঐতিহ্যবাহী ওষুধ অনুষদ গঠনের পর আমরা এ ক্ষেত্রে জ্ঞান অর্জন এবং গবেষণায় নিজেদের সামর্থ্য অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে প্রমাণ করেছি। ২০২২ সাল থেকে এ ধরনের ওষুধ উৎপাদনে বিশ্বে আমরা চতুর্থ স্থান অর্জন করেছি যা আমাদের জন্য একটি বিশেষ সাফল্য।

গুরুতর স্ট্রোক চিকিৎসায় শীর্ষ দশ দেশের মধ্যে ইরান

গুরুতর স্ট্রোক চিকিৎসায় ইরান বিশ্বের দশটি সফল দেশের মধ্যে একটি। ন্যাশনাল ইরানি স্ট্রোক কমিটির সদস্য এহসান শরিফিপুর একথা বলেছেন। তিনি জানান, ইরানে মৃত্যুর দ্বিতীয় প্রধান কারণ স্ট্রোক। এটি বিশ্বের একটি বড় চ্যালেঞ্জ এবং বিশ্বব্যাপী শারীরিক অক্ষমতার অন্যতম প্রধান কারণ। স্ট্রোক ব্রেন অ্যাটাক নামেও পরিচিত। সাধারণত মস্তিষ্কের একটি অংশে রক্ত সরবরাহ ব্যাহত হলে এটি ঘটে থাকে। এই ক্ষেত্রে হয় ভেসেলগুলো ব্লক হয় বা সেগুলোর রক্তপাত হয়, উভয় ক্ষেত্রেই মস্তিষ্কের যে কোনো অংশে রক্ত প্রবাহ ব্যাহত হয়।

ক্যান্সার নির্ণয়ে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর তালিকায় ইরান

উন্নত ন্যানোমেডিসিন ট্যালম্যানোসেপ্ট তৈরির মাধ্যমে ইরান ক্যান্সার নির্ণয় প্রযুক্তিতে শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর কাতারে যোগ দিয়েছে। এই সাফল্যের মাধ্যমে, ইরানের বিভিন্ন ক্যান্সারে আক্রান্ত প্রায় ৯০ শতাংশ রোগী রোগ নির্ণয় এবং চিকিৎসার জন্য একটি সস্তা এবং আরও সঠিক পদ্ধতিতে প্রবেশ করতে পারবেন। বার্তাসংস্থা ইরনা  জানিয়েছে, ইরানের একটি জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি এই প্রযুক্তি অর্জন করেছে। এর মাধ্যমে ইরানকে এই ধরণের উন্নত ক্যান্সার নির্ণয় প্রযুক্তির অধিকারী দ্বিতীয় দেশ হিসেবে বিশ্বের দরবারে তুলে ধরা হয়।

ইরানে ইনজেকশনযোগ্য অ্যান্টিক্যান্সার ওষুধ উন্মোচন

ইরানের একটি জ্ঞানভিত্তিক কোম্পানি ইনজেকশনযোগ্য একটি ওষুধ তৈরি করেছে। ওষুধটি বিস্তর পরিসরে ক্যান্সারের চিকিৎসায় ব্যবহৃত হয়। ‘সাইক্লোফসফামাইড’ নামের ফার্মাসিউটিক্যাল পণ্যটি আলবোর্জ প্রদেশে অবস্থিত একটি ইরানি কোম্পানি উন্মোচন করেছে।

এদিকে, ফুসফুস ক্যান্সারের চিকিৎসায় একটি অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য সিলিকন ভ্যালি ইন্টারন্যাশনাল ইনভেনশন ফেস্টিভাল (এসভিআইআইএফ) ২০২৪-এ প্রথম স্থান লাভ করেছেন ইরানি উদ্ভাবক মোস্তফা শামলুই।

ইরানের পশ্চিমাঞ্চলীয় শহর হামেদানের বাসিন্দা শামলুই বার্তা সংস্থা ইরনাকে বলেছেন, ক্যালিফোর্নিয়ার একটি বিশ্ববিদ্যালয় অ্যান্টিবডি তৈরির জন্য তাঁর প্রাথমিক পরিকল্পনা অনুমোদন করে। তিনি উৎসবে ১১ সদস্যের একটি দলের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এটি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন প্রদর্শনী। তিনি বলেন, ৪০টি দেশ থেকে উৎসবে অংশ নেওয়া ১ হাজার ২শ জনের মধ্যে তিনি প্রথম স্থান অধিকার করেছেন।

অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে বিশ্বের শীর্ষ তিন দেশের একটি ইরান

চিকিৎসা ক্ষেত্রে ব্যাপক অগ্রগতির কারণে ‘বোন ম্যারো ট্রান্সপ্লান্ট’ বা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান বিশ্বের তিনটি শীর্ষস্থানীয় দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরান চিকিৎসাবিজ্ঞানের যেসব ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে সেগুলোর মধ্যে অস্থি মজ্জা প্রতিস্থাপন একটি।

লিউকেমিয়া (অস্থিমজ্জার ক্যান্সার), লিম্ফোমা (রক্ত ও লসিকা টিউমারের একটি গ্রুপ), মাল্টিপল মায়েলোমা (রক্তের প্লাজমা কোষের ক্যান্সার) এবং অ্যাপ্লাস্টিক অ্যানিমিয়ার (অবর্ধক রক্তশূন্যতা) মতো অন্যান্য হেমাটোলজিক্যাল ম্যালিগন্যান্সিতে আক্রান্ত ব্যক্তিদের মধ্যে ইরানে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। এই প্রতিস্থাপনটি অনেকগুলো অনকোলজিকাল ক্যান্সারের ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে যা কেমোথেরাপিতে সাড়া দেয় না, যেমন টেস্টিকুলার ক্যান্সার, নিউরোব্লাস্টোমা এবং মেডুলোব্লাস্টোমা। সেই সাথে থ্যালাসেমিয়া, সিকেল সেল ডিজিজ, পোরফাইরিয়া এবং গুরুতর ইমিউনোডেফিসিয়েন্সি ডিসঅর্ডারের মতো জন্মগত ব্যাধি।

সাম্প্রতিক বছরগুলোতে ইরানের বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য কিছু করতে সক্ষম হয়েছেন এবং এই ক্ষেত্রে বিশ্বের শীর্ষ তিনটি দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছেন।

সম্প্রতি, একটি জ্ঞানভিত্তিক ইরানি কোম্পানি অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের রোগীদের জন্য বিশেষভাবে অ্যালোজেনিক সেল থেরাপি ড্রাগ ‘ডেস্ট্রোসেল’ তৈরি করেছে, যা এই ক্ষেত্রের রোগীদের জন্য অনেক সহায়ক। ডেট্রোসেল ওষুধটি গ্র্যাফট-ভার্সাস-হোস্ট ডিজিজ বা জিভিএইচডি-এর জটিলতা কমাতে পারে।

এ প্রসঙ্গে ইরানের জৈবপ্রযুক্তি, স্বাস্থ্য এবং চিকিৎসাপ্রযুক্তি সদর দপ্তরের সচিব মোস্তফা কানেয়ী ২০২৪ সালের ২৯ অক্টোবর ডেস্ট্রোসেল ওষুধের উন্মোচন অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনে ইরান এই অঞ্চলের শীর্ষস্থানীয় দেশগুলোর মধ্যে একটি। তাই ইরানের অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের পরিসংখ্যান এই অঞ্চলের অন্যান্য দেশের তুলনায় অনেক এগিয়ে।’

সার্জিক্যাল রোবট তৈরিতে ইরানের সাফল্য

ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের তৈরি সিনা সার্জিক্যাল রোবট দেশটির চিকিৎসা ব্যবস্থায় এক নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। নির্ভুল অস্ত্রোপচারের জন্য রোবটটি দেশের ভেতরে ও বাইরে ব্যাপকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। প্রেস টিভির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ইন্দোনেশিয়ার হাসপাতালগুলোতে অস্ত্রোপচারের জন্য সরবরাহ করা ইরানের তৈরি সিনা রোবটগুলো দেশটির পেশাদার চিকিৎসকদের অবাক করেছে। ইন্দোনেশিয়ার হাসপাতালগুলোতে সিনা সার্জিক্যাল সিস্টেমের সাথে কাজ করা সার্জনরা সিনা রোবটের কর্মক্ষমতা নিয়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, রোবটের সহায়তায় টেলিসার্জারি অপারেশনে সিনা কীভাবে ব্যবহার করবেন সে সম্পর্কে প্রশিক্ষণ কোর্সে যোগদানের জন্য প্রায় ১০০ জন নতুন ইন্দোনেশিয়ান সার্জন আবেদন করেছেন। দুই বছর আগে ইন্দোনেশিয়ায় সিস্টেম সরবরাহ করার পর থেকে ১১২ জন সার্জন এই কোর্সে যোগদান করেছেন।

পশ্চিম এশিয়ায় চক্ষু চিকিৎসায় প্রথম স্থানে ইরান

ইরান পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে চক্ষুবিদ্যার ক্ষেত্রে প্রথম স্থানে রয়েছে এবং দেশটি এই ক্ষেত্রে বিশ্বের সবচেয়ে উন্নত দেশগুলোর সাথে প্রতিযোগিতা করছে। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের চক্ষুবিদ্যা বিভাগের চেয়ারম্যান ডা. মাহমুদ জাব্বারভান্দ বলেছেন, ইরান বছরে লক্ষলক্ষ মেডিকেল পর্যটককে স্বাগত জানাচ্ছে এবং কোনো ইরানি রোগীকে চিকিৎসার জন্য বিদেশে পাঠানো হয় না। তিনি বলেন, চক্ষুবিদ্যার ক্ষেত্রে গবেষণা ও গবেষণার সুযোগের পরিপ্রেক্ষিতে ইরান বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে তুলনীয়।

বিশ্বে জেনেটিক কিট উৎপাদনকারী শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে ইরান

নিষেধাজ্ঞা দিয়ে অত্যাধুনিক চিকিৎসা প্রযুক্তি অর্জনে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের প্রচেষ্টাকে বাধাগ্রস্ত করা সত্ত্বেও দেশটি বিশ্বজুড়ে জেনেটিক কিট উৎপাদনকারী শীর্ষ পাঁচ দেশের মধ্যে স্থান করে নিয়েছে। ইরানের একজন সিনিয়র স্বাস্থ্য কর্মকর্তা এই তথ্য জানিয়েছেন।

ইরানের ফরেনসিক মেডিসিন অর্গানাইজেশনের ল্যাবরেটরি বিভাগের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেন, নিষেধাজ্ঞা দিয়ে উচ্চ প্রযুক্তির ক্ষেত্রে ইরানকে জেনেটিক কিট আমদানিতে বাধা দেয়া হয়েছে। কিন্তু স্বনির্ভরতা লাভে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরানের দীর্ঘ দিনের প্রচেষ্টা সফল হয়েছে।

বেদনানাশক ক্রিম তৈরিতে ইরানের সাফল্য

বেদনানাশক ক্রিম তৈরি করেছেন ইরানের একদল গবেষক। দেশটির জ্ঞানভিত্তিক একটি কোম্পানির গবেষকরা জীবাণুবিরোধী উপাদান সংবলিত এই ক্রিম উৎপাদন করেছেন। এটা বাতগ্রস্ত রোগীরা ব্যবহার করতে পারবেন।

ওষুধশিল্পের প্রযুক্তি রপ্তানিতে ইরানের সাফল্য

বিশ্বে ওষুধ শিল্পের বৃহত্তম প্রযুক্তি রপ্তানিকারক দেশে পরিণত হতে যাচ্ছে ইসলামি প্রজাতন্ত্র ইরান। দেশটির সবচেয়ে বড় ওষুধ কোম্পানি সিন্নাজেন ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) ড. হালেহ হামেদিফার এই তথ্য জানিয়েছেন।

তেহরান চেম্বার অব কমার্স, ইন্ডাস্ট্রিজ, মাইনস অ্যান্ড এগ্রিকালচার (টিসিসিআইএমএ) এর রিপ্রেজেনটেটিভ বোর্ডের এক বৈঠকে তিনি এসব কথা বলেন। তিনি জানান, ইরানে প্রথম বারের মতো সিন্নাজেন ফার্মাসিউটিক্যাল গ্রুপ ওষুধ শিল্পের নেতৃস্থানীয় রপ্তানিকারক ফার্ম হিসেবে পরিচিত হতে যাচ্ছে।

মৌলিক কোষ নির্মাণ প্রযুক্তিতে ইরানের সাফল্য

শক্তিশালী মৌলিক কোষ নির্মাণ গবেষণা ও চিকিৎসা বিজ্ঞানের সবচেয়ে জটিল বা অত্যাধুনিক ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম। এই প্রযুক্তি গত কয়েক দশকে চিকিৎসা বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে, বিশেষ করে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গের নষ্ট হয়ে-যাওয়া কাঠামো মেরামত ও বিভিন্ন অঙ্গের জোড়া লাগানোর কাজে বড় ধরনের বিপ্লব সৃষ্টি করেছে ইরান। ভ্রুণের মৌলিক কোষ এমন কিছু প্রাথমিক কোষ যেগুলো বিভিন্ন কোষে রূপান্তরিত হবার ক্ষমতা রাখে। গবেষণাগারের পরীক্ষায় দেখা গেছে ভ্রুণের মৌলিক কোষ শরীরের ক্ষতিগ্রস্ত বা আঘাতপ্রাপ্ত অংশের কাঠামোয় জোড়া লেগে যায়। জোড়া লেগে যাবার পর কোষগুলো ঐ বিশেষ অঙ্গের কোষে পরিণত হয়। এ ছাড়াও এই কোষগুলো থেকে নতুন অনেক কোষ তৈরি করা যায় এবং নতুন এই কোষগুলোকে শরীরের বিভিন্ন অংশের কাঠামোয় ব্যবহার করা যায়। মৌলিক কোষগুলো এত শক্তিশালী যে, সেগুলো সংখ্যা বৃদ্ধির সময় ও বিভিন্ন অঙ্গে বা স্থানে প্রতিস্থাপনের সময় নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে পারে।

হৃদযন্ত্র , কিডনি, যকৃত ও ফুসফুস প্রতিস্থাপনে ইরানের সাফল্য

হৃদযন্ত্র, কিডনি, যকৃত ও ফুসফুস প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রেও ইরানি চিকিৎসকদের খ্যাতি আজ বিশ্বজুড়ে। ইরান ডেইলিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ বাবাক শারিফ-কাশানি বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে ইরান হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগ চিকিৎসায় শীর্ষে অবস্থান করছে।

বাবাক শারিফ-কাশানি বলেন, তেহরানের মাসিহ দানেশভারি হাসপাতাল, ইমাম খোমেইনি হাসপাতাল, আয়াতুল্লাহ তালেঘানি হাসপাতাল ও শারিয়তি হাসপাতালসহ ইরানের বিভিন্ন প্রদেশের হাসপাতালগুলোতে  এধরনের হৃদযন্ত্র প্রতিস্থাপন ও হৃদরোগের বিভিন্ন ধরনের অস্ত্রোপচার সম্পন্ন হচ্ছে। তিনি ইরানের হৃদরোগ সার্জনদের বিশ্বের অন্যতম সেরা চিকিৎসক হিসেবে দাবি করেন। এদিকে, কিডনি, যকৃত ও ফুসফুস প্রতিস্থাপনেও ইরান নজরকাড়া সাফল্য অর্জন করেছে।

নিঃসন্তান দম্পতিদের চিকিৎসায় ইরানের সাফল্য

নিঃসন্তান দম্পতিদের চিকিৎসার জন্যও ইরান হয়ে উঠতে পারে সঠিক গন্তব্য। এধরনের চিকিৎসায় ইরানের চিকিৎসকরা বেশ সফলতা অর্জন করেছেন। এক সাক্ষাৎকারে ইরান ডেইলিকে প্রখ্যাত চিকিৎসক সাঘার সালেপুর জানান, বিশ্বের অত্যাধুনিক চিকিৎসাব্যবস্থা নিশ্চিত করা হয়েছে ইরানে। বিশ্বের আধুনিক ইনফার্টিলিটি ট্রিটমেন্ট মেথড অনুসরণ করা হচ্ছে। বিভিন্ন দেশ থেকে অনেক নিঃসন্তান দম্পত্তি ইরানে চিকিৎসা নিতে আসছেন। চিকিৎসা খরচ তুলনামূলকভাবে কম হওয়ায় অনেকে এই সুযোগ গ্রহণ করছেন।

ওষুধ শিল্প, মেডিকেল সরঞ্জাম, উন্নত চিকিৎসাকেন্দ্র, দক্ষ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক, চিকিৎসা ব্যায় সবকিছু বিবেচনায়  মেডিক্যাল ট্যুরিজম শিল্পে ইরান এখন বিশ্বসেরা দেশগুলোর কাতারে রয়েছে। এখন সারা বছর জুড়েই বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে বহু মানুষ চিকিৎসার জন্য ইরানে আসছেন। বেশিরভাগ রোগী হলেন ব্রিটেন, সুইডেনসহ পারস্য উপসাগরীয় দেশগুলোর। ইরানের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের স্বাস্থ্য নীতিতে চিকিৎসা ব্যয় কমানোর ওপর গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ কারণে ইরানে যে-কোনো অপারেশনের ব্যয় বিশ্বের অনেক দেশের তুলনায় কম। তবে চিকিৎসার গুণগত অবস্থা বিশ্বমানের। সেজন্যেই বিদেশি রোগীরা ইরানের চিকিৎসার মানের ব্যাপারে সন্তুষ্ট। এছাড়া ইরানি অস্ত্রোপচারকারী চিকিৎসক এবং সাধারণ চিকিৎসকগণ বেশ দক্ষ। বিদেশি সহযোগীরা সবসময়ই তাঁদের প্রশংসায় পঞ্চমুখ।

২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বের ১৬৪টি দেশ থেকে বছরে প্রায় ১২ লাখ রোগী মেডিক্যাল ট্যুরিজমের লক্ষ্যে ইরান সফরে আসছেন এবং ইরানের উন্নত চিকিৎসা সেবা গ্রহণ করে উপকৃত হচ্ছেন। ইরানের এই চিকিৎসা সেবা বিশ্বের চিকিৎসকগণকেও আকৃষ্ট করছে। গত ৩ মার্চ ২০২৫  সোমবার জাতিসংঘের পর্যটন বিষয়ক মহাসচিব জুরাব পোলোলিকাশভিলি পর্যটন শিল্পে টেকসই উন্নয়নে ইরানের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার কথা তুলে ধরেছেন। ইরানের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, পর্যটন ও হস্তশিল্প মন্ত্রী রেজা সালেহি-আমিরিকে লেখা এক চিঠিতে গত মাসে ইরানের রাজধানীতে অনুষ্ঠিত ১৮তম তেহরান আন্তর্জাতিক পর্যটন প্রদর্শনীতে সাংগঠনিক মান এবং উচ্চস্তরের অংশগ্রহণের প্রশংসা করেছেন। তিনি এই অনুষ্ঠানটিকে একটি বিশিষ্ট প্ল্যাটফর্ম হিসেবে বর্ণনা করেছেন যা আন্তর্জাতিক পর্যটন মিথস্ক্রিয়ার জন্য উদ্ভাবনী কাঠামো তুলে ধরে এবং কার্যকরভাবে সরকারি ও বেসরকারি খাতের উদ্যোগগুলোকে এক ছাতার নিচে একত্রিত করে।

 লেখক: সাংবাদিক ও লেখক এবং ইরান পর্যটন বিশেষজ্ঞ

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »
error: Content is protected !!