ব্যভিচার

স্বপ্ন জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ ভ্রমণ। প্রায় সব মানুষই স্বপ্ন দেখেন। স্বপ্ন তিন রকমের হতে পারে। ভালো স্বপ্ন, মন্দ স্বপ্ন এবং মানুষ যা চিন্তা করে বা ভাবে তারই রূপায়ন সে স্বপ্নে দেখে।

কিছু কিছু স্বপ্ন মানুষের বাস্তব জীবনের প্রতিচ্ছবি। কোনো কোনো স্বপ্ন অতীত-বর্তমানকেও প্রতিফলিত করে। আর কিছু স্বপ্ন শুধুমাত্র ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। মানুষ এমনও বহু স্বপ্ন দেখে যা সে কোনোদিন কল্পনাও করেনি বা যা সে মুখে প্রকাশ করতেও লজ্জিত হয়। আবার একই স্বপ্ন ব্যক্তিভেদে ভিন্ন ভিন্ন মানে হতে পারে।

বাস্তবতার সাথে স্বপ্নের মিল থাকলেও তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয়া দুরূহ। প্রকৃত ব্যাখ্যা উদ্ধার করা সকলের পক্ষে সম্ভব নয়। পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত অল্প ক’জন স্বপ্ন ব্যাখ্যাকারের পরিচয় পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে অন্যতম শ্রেষ্ঠ বিশারদ হিসাবে ইবনে সিরীনের নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।

স্বপ্ন ও বাস্তবতার মধ্যে যেখানে বিবেক-বুদ্ধি ও যুক্তি-তর্কের মাধ্যমেও কোনো মিল খুঁজে পাওয়া যায়না, সেখানে তাক লাগানো ও অবাক করে দেয়ার মতো ব্যাখ্যা প্রদান করে বাস্তবিক স্বপ্ন জগতে তার পরিপক্কতারই স্বাক্ষর বহন করে। পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত স্বপ্ন ও তার ব্যাখ্যা যেগুলো সত্যি বলে প্রমাণিত হয়েছিলো তা স্বপ্নভ্রমণ এর এই নিয়মিত বিভাগে ছাপা হবে। এই পর্যায়ে আজ উপস্থাপিত হলো ‘ব্যাভিচার’।

আরবে পানির সংকট অনেক আগে থেকেই ছিলো। খলিফা হারুনুর রশীদের সময়কালে সেই সংকট আরো তীব্র হয়। হজ্ব করতে আসা লোকেরাও পানির জন্য কষ্ট পেতেন। এমনই এক সময় খলীফার স্ত্রী জোবায়েদা খাতুন একটি স্বপ্ন দেখেন। অতি বিভৎস কুৎসিত স্বপ্ন। তিনি দেখলেন পৃথিবীর নানাপ্রান্ত থেকে মানুষরা এসে তার সাথে ব্যভিচার করছে। মিলিত হয়ে পরিতৃপ্ত হচ্ছে। স্বপ্ন দেখে খলিফা পতœীর ঘুম ভেঙ্গে গেলো। ঘেন্যা, লজ্জা এবং দু:শ্চিন্তায় তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। এমন স্বপ্নের কথা কারো সাথে শেয়ার করাও অস্বস্তিকর। এমন স্বপ্ন তিনি কেন দেখলেন? এই স্বপ্নের মানেই বা কী? এসব ভাবনা তাকে পেরেশান করছিলো। এই দুর্ভাবনার মধ্যে তার মাথায় বুদ্ধি এলো। তিনি বিশ্বস্ত এক নারী কর্মচারীকে ডেকে ঘটনা জানালেন। তাকে জগতবিখ্যাত স্বপ্ন ব্যাখ্যাকার ইবনে সীরীনের কাছে যেতে বললেন। শিখিয়ে দিলেন, ইবনে সিরীনকে সে যেন বলে এই স্বপ্ন সে (মহিলা কর্মচারী) দেখেছে। খলিফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী দেখেছে এটা বলতে নিষেধ করলেন।

জোবায়দা বেগমের বিশ্বস্ত কর্মী ইবনে সিরীনের কাছে যেয়ে স্বপ্নের বিবরণ দিলেন। ইবনে সিরীন জিজ্ঞেস করলেন, এই স্বপ্ন কে দেখেছে?

বাদী বললো, আমি।

ইবনে সিরীন বললেন, এই স্বপ্ন তোমার দেখার কথা না। ঠিক করে বলো, কে দেখেছে?

বেগম সাহেবের বিশ্বস্ত কর্মচারী আবারো বললো, আমি এই স্বপ্ন দেখেছি। এই স্বপ্নের মানে কি আপনি বলুন!

ইবনে সিরীন জবাব দিলেন, ঠিকঠাক করে স্বপ্নদ্রষ্টার পরিচয় বলো। পরিচয় না দিয়ে এই স্বপ্নের ব্যাখ্যা করা যাবে না। দাসী নির্দেশ মোতাবেক পুনরায় দৃঢ়তার সাথে বললো, এই স্বপ্ন আমিই দেখেছি। আপনি এর অর্থ বলুন।

ইবনে সিরীন জানিয়ে দিলেন, এই স্বপ্ন তুমি দেখতেই পারো না। এখন বিদায় হও এবং নিশ্চিত হয়ে জেনে আসো স্বপ্ন সত্যিকার অর্থে কে দেখেছে?

কর্মচারি খলিফা পতœীর কাছে ফিরে এলেন। ইবনে সিরীনের সাথে তার কথোপকথনের বিবরণ দিলেন। সবশুনে খলিফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী দাসীকে বললেন তুমি ইবনে সিরীনের কাছে আবার যাও। সত্য পরিচয় দিয়ে বলোআমি এই স্বপ্ন দেখেছি। এই ভয়াবহ লজ্জাজনক স্বপ্নের মানে কি জেনে আসো।

নারী কর্মচারী ইবনে সিরীনের কাছে ফিরে এলেন। জানালেন এই স্বপ্ন আরবের শাসক খলিফা হারুনুর রশীদের স্ত্রী জোবায়দা খাতুন দেখেছেন।

ইবনে সিরীন প্রসন্ন ভঙ্গিতে বললেন, হ্যাঁ। এই স্বপ্ন উনি দেখতে পারেন। এই স্বপ্নের মানে হচ্ছে বেগম সাহেবার দ্বারা একটি মহৎ কাজ সম্পন্ন হবে। যার দ্বারা পৃথিবীর বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ উপকৃত হবে।

পরবর্তিকালে এই স্বপ্ন সত্যি হয়েছিলো। হজ্বের সময় হাজীদের পানিকষ্ট দূর করার জন্য জোবায়দা খাতুন মক্কা হতে মদীনা শরিফ পর্যন্ত একটি বৃহৎ খাল খনন করিয়েছিলেন, যা  ‘নহরে জোবায়দানামে বিখ্যাত হয়ে তার অক্ষয় কীর্তি ঘোষণা করছে।

ইয়াসমিন আশরাফি

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »
error: Content is protected !!