
জাকারিয়া মন্ডল
সাত সকালেই ব্যস্ত হয়ে উঠেছে নুয়ারা এলিয়া। শ্রীলংকার শীতলতম শহরের সকালটাও শীতল। পূর্বদিকের পাহাড়সারির মাথায় সূর্যটা সবে জেঁকে বসে উষ্ণতা বাড়াতে শুরু করেছে। শিশির ধোয়া পরিচ্ছন্ন রাজপথে যান চলাচল বাড়ছে। উত্তর থেকে দক্ষিণে ছুটছে গাড়ি। রেসকোর্স ময়দান পড়ে রইলো বাঁয়ে। আরও সামনে হাতের বাঁয়েই গ্রেগরি পার্ক। পেছনে গ্রেগরি লেক। পর্যটকদের বিশেষ বিনোদন স্পট।
দ্রুতই পেছনে পড়ে গ্রেগরি পার্ক। তার পেছনে নুয়ারা এলিয়া। ব্রিটিশ নিদর্শন সমৃদ্ধ শহরের সীমানা ছাড়ার খানিক পর আরও অতীতের মুখোমুখি। সামনে পাঁচ হাজার বছর আগে রচিত মহাকাব্যের খোলা পাতা। রাস্তার ঢালে সীতা আম্মান টেম্পল। মানে সীতা মায়ের মন্দির।
ছাদের ওপরে হনুমানের বিভিন্ন আকৃতির মূর্তি। এক কোনায় ডানাওয়ালা জটায়ু দন্ডায়মান। বাল্মিকী রচিত রামায়ণের কাহিনীকাব্যে, ইন্দ্রের বাহন গড়–রের বড় ভাই তিনি। সূর্য-সারথী অরুণের পুত্র। সীতাকে হরণকালে উড়ে এসে রাবণকে বাধা দেন। কিন্তু, আকাশ যুদ্ধে রাবণের খড়গের আঘাতে পাখা কাটা পড়ে তার। তারপর ভূপাতিত হয়ে মৃত্যু। তাই রামায়ণের উল্লেখযোগ্য চরিত্রগুলোর মধ্যে জটায়ু অন্যতম। কিন্তু মন্দিরের শরীরে তার মূর্তি বিরলই বটে!
পাশের সিঁড়ি বেয়ে নামলে গর্ভগৃহে সীতা, রাম ও লক্ষ্মণের প্রস্তর প্রতিমা।

সীতা মন্দির
বস্তুত এটাকে সেই স্থান বলে মনে করা হয়, সীতাকে হরণ করে এনে রাবণ যেখানে তাকে বন্দি করে রেখেছিলেন। টানা চার বছরের গবেষণায় এ স্থানটি চিহ্নিত করা হয়েছে শ্রীলংকান ট্যুরিজম অথরিটির তত্ত্বাবধানে। আধ্ম্যাতিক পর্যটনের প্রসারে এই শতাব্দির গোড়ার দিকে অনুসন্ধানি ও গবেষক দল নিয়োগ দিয়েছিলো তারা। দীর্ঘ গবেষণার পর সেই গবেষক দল জানায়, শ্রীলংকায় রামের যাত্রা পথ প্রাচীন মন্দির ও বিভিন্ন ল্যান্ডমার্কসহ এখনও ভৌগলিকভাবে শনাক্ত করা যায়। তারই ধারাবাহিকতায় ২০০৮ খ্রিষ্টাব্দে রামায়ণ ট্রেইল নামে তারা যে ভ্রমণ পথ উন্মোচন করে, তার অন্যতম এই সীতা মা মন্দির। কাহিনীকাব্য রামায়ণে বর্ণিত মোট ৫৯টি স্থান চিহ্নিত করা হয় সেসময়। এই মন্দির ছাড়াও সে তালিকার অন্যতম হলো রাবণের প্রাসাদ। আছে রাম–রাবণের মূল যুক্ষক্ষেত্র, বর্তমানে যা বন্যপ্রাণি অভয়াশ্রম হিসেব স্বীকৃত। সেখানে নাকি ঘাস ছাড়া আর কোনো উদ্ভিদ জন্মায় না। চিহ্নিত করা হয়েছে পাহাড়ের উপরের সেই পুকুর, যেটি সীতার চোখের জল জমে তৈরি বলে বিশ^াস প্রচলিত। আরও চিহ্নিত করা হয়েছে হনুমানের হাত থেকে সঞ্জিবনি পাহাড় পতিত হওয়ার স্থান, অশোক বন, রাবণের গুহা ও সুড়ঙ্গসহ আরও অনেক স্থান। এসব স্থানের পরিচিতি ও প্রসারে দেশটির বিশ^খ্যাত ক্রিকেটার অর্জুনা রানাতুঙ্গা ও অরবিন্দ ডি সিলভাকে রামায়ণ ট্রেইল পর্যটনের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর নিয়োগ করা হয় তখন। তারপর এই সীতা মন্দিরে পর্যটক বাড়তে থাকে। মন্দিরটার পেছনে একটা পাহাড়ি ছড়া। গাছপালার ফাঁকে কুলকুলিয়ে বইছে।
বন্দি থাকাকালে সীতার প্রাত্যহিক কাজে লেগেছিলো বলে এ ছড়াটা এখানে সীতা নদী নামে পরিচিত।

মন্দিরের পেছনে সীতা নদী
শতাব্দিকাল আগে এই নদীতে কিছু পুরনো প্রস্তর মূর্তি পাওয়া গিয়েছিলো। সে কারণে প্রাচীনকালেও এখানে পূজার চল ছিলো বলে বিশ^াস প্রচলিত। নদীর কিছু স্থানে পোড়া মাটির দেখা মেলে। ওগুলোও হনুমানেরই পোড়ানো বলে মনে করা হয়। তার একটা মূর্তি আছে মন্দিরের পেছনে নদীর বুকে নেমে যাওয়া সিঁড়ির কিনারায়। হনুমান মূর্তিটির নিচে এ স্থানের মর্মগাথা লিখে রাখা। ওপাড়ে নদীর পাথুরে বুকে এক গুচ্ছ গর্ত। সব কটা মিলে খানিকটা পায়ের আকৃতি নিয়েছে। ওটা আসলে হনুমানেরই পায়ের ছাপ বলে বিশ^াস প্রচলিত। রাবণ রাজ্য লংকায় সীতা বন্দি থাকাকালে হনুমান এসে তার সঙ্গে দেখা করেছিলেন বলে লেখা আছে রামায়ণে। আর স্থানীয় বিশ^াসে, এটাই সেই স্থান।
মধ্য প্রদেশের জেলা শহর নুয়ারা এলিয়া থেকে এ স্থান প্রায় আট কিলোমিটার দক্ষিণে। তবে নুয়ারা এলিয়া জেলার সীমানার মধ্যেই। আর সীতা মা মন্দিরের আশপাশের জনবসতির নাম সীতা এলিয়া। প্রতিদিন সকাল আটটা থেকে দুপুর একটা এবং দুপুর ২টা থেকে সাড়ে ছয়টা পর্যন্ত ভক্তরা এসে পূজা দিতে পারেন এখানে। আজ দিনের প্রথম প্রহরে সবে খুলেছে মন্দিরটা। দলে দলে ভক্তরা পূজা দিতে আসছেন। নব বিবাহিত এক দম্পতি বিয়ের সাজেই ভক্তি জানাতে এসেছে। পুরো এলাকাটা রোদে ঝলোমলো। পাহাড় পেরিয়ে উঁকি দেওয়া সূর্যের ছটায় তাপ বাড়ার আভাস।
শ্রীলংকার সবচেয়ে বড় ঐতিহ্যবাহি ট্রাভেল কোম্পানি এইটকেন স্পেন্সের আধুনিক ট্যুরিস্ট বাসটা ফের পথে গড়ালো। ঢাকাস্থ শ্রীলংকান হাইকমিশনের উদ্যোগে শ্রীলংকান ট্যুরিজম প্রমোশন ব্যুরোর আমন্ত্রণে শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সে উড়ে আসা বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশনের ছয় ভ্রামণিক গত কয়েকদিন ধরেই এই বাসটার যাত্রী।
পাহাড় চিরে এগিয়ে চলা পথের দুপাশ সবুজে ছাওয়া। পাহাড়, গিরিখাদ, উপত্যকা ঘন সবুজ গাছপালায় আচ্ছাদিত। রাস্তার ডান ঘেঁষে হাকগালা বোটানিক্যাল গার্ডেন। শ্রীলংকার পাঁচটি বিখ্যাত গার্ডেনের মধ্যে দ্বিতীয় বৃহত্তম। রেকর্ড বলছে, ম্যালেরিয়া রোগের প্রতিষেধক তৈরির জন্য ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দে সিনকোনা গাছ চাষের প্রয়োজনে এ বাগানের জন্ম। পরে এখানে চা চাষ শুরু হয়। আরও পরে জায়গাটা পরিণত হয় বোটানিক্যাল গার্ডেনে।
কিন্তু জনশ্রুতিতে, এই বাগান সেই রামায়ণ যুগ থেকেই বিদ্যমান। এটা সেই অশোক বন, যার ঢালে সীতাকে বন্দি রেখেছিলেন রাবণ। এ বনের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ছোট্ট ছড়াটাই একটু আগে দেখা সীতা আম্মান টেম্পলের পাশের সেই নদী। বন্দি থাকাকালে যে স্রোতে স্নান করতেন সীতা। বলা হয়ে থাকে, সীতা আম্মান টেম্পলের গর্ভগৃহে রাম, সীতা ও লক্ষ্মণের কালো গ্রানাইট পাথরের যে মূর্তি তিনটি রয়েছে, সেগুলো এই অশোক বন থেকে নিয়েই সেখানে প্রতিষ্ঠা করা। সীতার সঙ্গে দেখা হওয়ার পর হনুমান এই অশোক বন বিনষ্ট করেছিলেন।
এ বনের অবস্থান সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় পাঁচ হাজার ৪শ ফুট উঁচুতে, হাকগালা পাহাড়ের উত্তর–পূর্ব দিকে। সিংহলি শব্দ হাকগালার অর্থ হলো চোয়াল পাথর। স্থানীয় আর এক জনশ্রুতিতে, মহাকাব্য রামায়ণে ওষুধি চিনতে না পেরে হিমালয়ের যে পাহাড়টিকেই কাঁধে তুলে নিয়ে এসেছিলেন হনুমান, এটা সেই পাহাড়।

যেটাকে বলা হচ্ছে হনুমানের পদচিহ্ন
বর্তমানে এই পাহাড়ের উচ্চতা ভূপৃষ্ঠ থেকে সাত হাজার একশ ফুটেরও উপরে। পশ্চিমে ওই পাহাড় ও তার ঢালের বোটানিক্যাল গার্ডেনকে পাশ কাটিয়ে নুয়ারা এলিয়া জেলার সীমানা পার হয় ট্যুরিস্ট বাস। মধ্য প্রদেশ থেকে বেরিয়ে ঢুকে পড়ে উভা প্রদেশের সীমানায়। হাকগালা শহরকে পেরিয়ে ছুটতে থাকে বাদুল্লা রোডে। পার হয় ব্রিটিশ বিরোধী ব্যর্থ বিদ্রোহের শহর কেপেটিপোলা। পার হয় উমা নদী। পাশাপাশি চলতে চলতে পাহাড়ি পথ একসময় উমা নদীর উজান ধারার সঙ্গ ছাড়ে।
রাস্তাটা এবার পূর্বমুখী। সামনে উত্তর–পূর্ব দিকে বাঁক নিয়ে উভা প্রদেশের রাজধানী বাদুল্লা শহরের দিকে এগিয়েছে। ওদিক থেকে নেমে এসে বাদুল্লা নদী যেখানে দক্ষিণমুখি বাঁক নিয়েছে, সেখানে হালি–এলা শহর। ট্যুরিস্ট বাস এবার বাদুল্লা রোড ছেড়ে দক্ষিণে নদীর পাশাপাশি ছুটতে থাকে। পাহাড় ফুঁড়ে এগুনো রেল ট্যানেলের জন্য খ্যাত দামোদর শহর ছাড়িয়ে কুমবালবেলা জংশনে ফের পূর্বমুখি যাত্রা।
আরও খানিক এগুতেই এলা শহর। পাহাড়ের কোলে ছোট্ট জনপদ। দুপাশে সারিসারি রেস্তোরাঁ, হোটেল। ছোট আদম পাহাড়ের পাদদেশে এসে শেষ হয় ৮০ কিলোমিটারের যাত্রাপথ।

লিটল অ্যাডামস পিকের ওপাশে পাহাড়ের গায়ে রাস্তা
শুরু হয় ছোট আদম পাহাড়ে ওঠা। প্রথমে পাহাড়ের শরীর পেঁচিয়ে ওঠা পিচঢালা পথ। তারপর গুচ্ছ গুচ্ছ সিঁড়ি। কখনও এবড়োথেবড়ো পাথুরে পথ।
পাহাড়ের ঢালে চা বাগান। পাহাড়ের কাঁধে বাড়িঘর। উপত্যকায় সবুজ ধান খেত।
মাথার ওপর সূর্য জ¦লছে। চারপাশের উঁচু পাহাড়ে ধাক্কা খেয়ে ফিরে যাচ্ছে বাতাস। গুমোট গরমে ঘাম ছুটছে শরীরে। ফ্ল্যাইং রাবণ বেস ক্যাম্পে এসে কিছুটা জিরোনোর সুযোগ।
বাল্মীকির রামায়ণে, উড়ন্ত যান ছিলো রাবণের। সেটার নাম ছিলো পুষ্পক রথ। সেই যানে তিনি উড়ন্ত পথে গন্তব্যে যেতেন। শ্রীলংকান ট্যুরিজম অথরিটি রামায়ণে বর্ণিত পাহাড়ের উপরে এমন পাঁচটি সমতল পিঠ চিহ্নিত করেছে, যেসব স্থান থেকে পুষ্পক রথে সওয়ার হতেন রাবণ। সে স্থানগুলোকে বলা হচ্ছে, রাবণের বিমানবন্দর। যে বিমানবন্দর থেকে উড্ডয়ন করে দ–কারণ্য থেকে সীতাকে হরণ করেছিলেন রাবণ, সেটিও চিহ্নিত করা হয়েছে। রাবণের ওই উড়ন্ত চরিত্রের সঙ্গে মিল রেখে এ স্থানের নাম রাখা হয়েছে ফ্ল্যাইং রাবণ। এটি মূলত একটি জিপলিং স্টেশন। কোমরে বেল্ট বেঁধে তারের হুকে হাত গলিয়ে উঁচু পাহাড় থেকে নিচের পাহাড়ে নেমে যাওয়া যায় ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার গতিতে।

লিটল অ্যাডামস পিকের নিচে এলা শহরের একাংশ
ফ্ল্যাইং প্ল্যাটফর্মে এখন অ্যাডভেঞ্চারপ্রেমিদের ভিড়। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও পাল্লা দিয়ে ঝুলন্ত তার বেয়ে নামছেন। উল্টোদিকে গাছের নিচে তীর–ধনুক সাজিয়ে রাখা। আর্চারি, অ্যাবসেইলিং, মাউন্টেন বাইকিং, এয়ার রিফলিং ইত্যাদি পাহাড়ি অ্যাডভেঞ্চারের আয়োজন সাজিয়ে রাখা আছে ছোট আদম পাহাড় ও লাগোয়া এলাকায়।
ফ্ল্যাইং রাবণ বেসক্যাম্পের পর আরও খাড়া হয়ে উঠেছে সিঁড়িগুলো। কোথাও কোথাও সিঁড়ির পাশে খাড়া খাদ। এবড়োথেবড়ো পথ মাড়িয়ে একসময় উঠে পড়া গেলো দুই চূড়ার মধ্যবর্তী ঘাড়ে।
গাছের ছায়ায় কিং কোকোনাটের দোকান। বাঁয়ের চূড়ার কিনারায় চ্যাপ্টা একটা পাথর পাহাড়ের কিনারায় ঝুলন্ত প্ল্যাটফর্ম তৈরি করে রেখেছে। ভিনদেশি এক অসীম সাহসি শিশু সেখানে পা ঝুলিয়ে পাহাড়ি সৌন্দর্য উপভোগে মগ্ন। গড়িয়ে পড়লেই ভবলীলা সাঙ্গ হওয়ার ভয়। কিন্তু অকুতোভয় শিশুটির বাবা–মাও নিরুদ্বেগ। সন্তানের ছবি তুলছে মা। সবাই মিলে পাহাড়ের রূপ উপভোগে বিভোর।
মূলত তিনটি চূড়া এখানে। কিন্তু একটি চূড়ার পথ খুবই সরু, বিপদজনক। পর্যটকরা তাই দুই চূড়া থেকেই যা কিছু উপভোগ করে। ডানের চূড়াটার ওপরে হেলিপ্যাডের মতো একটা সমতল চত্বর। এক পাশে একটা একচালার নিচে ধ্যানমগ্ন বুদ্ধ।
ভূপৃষ্ঠ থেকে এখানকার উচ্চতা ১১৪১ মিটার। চারদিক খোলা। এক স্থানে দাঁড়িয়ে ঘাড় ঘোরালেই ৩৬০ ডিগ্রি প্যানারোমিক ভিউ। সবুজে ছাওয়া পাহাড়, চা বাগান, জলপ্রপাত, ধানখেত। ওপাশে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে এগিয়েছে রাস্তা। ভোরে এ পাহাড় ঘিরে ভেসে বেড়ায় মেঘের দল। আজ ভর দুপুরে মেঘের চিহ্নও নেই কোথাও। তবে তেজ হারিয়েছে রোদ। হু হু বাতাসে পাহাড় বাওয়ার ক্লান্তি মিইয়ে যেতে সময় নিলো না। আদম পাহাড়ে, যেখানে গৌতম বুদ্ধ বা হযরত আদম বা মহাদেবের পদহ্নিত রক্ষিত বলে কথিত, সেই পাহাড়ের সঙ্গে মিল থাকার কারণেই নাকি সিংহলি ভাষায় এর নাম পুনচি শ্রীপদ। যার অর্থ লিটল অ্যাডামস পিক বা ছোট আদম পাহাড়।

পাহাড়ের গায়ে ঝুলন্ত রিসোর্ট
এ পাহাড়েরই হাজার মিটার উঁচুতে ৯৮ একরস রিসোর্ট অ্যান্ড স্পা। চারপাশ খোলা ছাদের নিচে ঝুলন্ত লবি। লবিতে বসলে চোখের সামনে ঝুলে থাকে ছোট আদম পাহাড়টা।
চা বাগানের ভেতর দিয়ে উঠে যাওয়া সিঁড়ির মাথায় খড়ের চালা। তার নিচে চারিদিকে খোলা রেস্তোরাঁ, বার। মধ্যাহ্নভোজের জন্য রকমারি খাবারের আয়োজন। অনতি দূরে পাহাড়ের গায়ে ঝুলে আছে লিভিং কটেজের সারি। চা বাগানের পরিচর্যায় রত নারী শ্রমিকরা। পাহাড় থেকে নামতে নামতে বিকেল।
ওক রে এলা গ্যাপ হোটেলের পাশে শোপিসের সুপারশপটা ক্রেতা শূন্য। কিন্তু মূল শহরের রেস্তোরাঁগুলো শেষ বিকেলের আগেই জমজমাট। একেকটার একেকরকম সাজসজ্জা। মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকতে হয়। টি শপে রকমারি চায়ের আয়োজন। দেখতে দেখতে ছোট্ট শহরের সীমানা শেষ হয়ে আসে। শহরের প্রান্তে ছিমছাম রেল স্টেশন। ট্রেনের সময় জানতে স্টেশনে এসেছে একদল রাশিয়ান পর্যটক। কিন্তু ট্রেনের সময় নয় বলে প্লাটফর্মে তালা। ক্যান্ডি থেকে এই স্টেশন পর্যন্ত রেলপথটাও শ্রীলংকার অন্যতম ট্যুরিস্ট আকর্ষণ। রেলপথে এলা শহরে ঢোকার আগেই নয় গম্বুজ সেতু। যার ছবি শ্রীলংকান ট্যুরিজমে অনেকটাই আইকনিক হয়ে উঠেছে।
অনতিদূরে মানদালা ক্যাফে এন্ড বারে জ¦লে উঠেছে সাঁঝবাতি। উচ্চস্বরে রক মিউজিক বাজছে। একজন দুজন করে জমায়েত হতে শুরু করেছে হিপ্পিরা। যদিও এ শহর রাত নটাতেই ঘুমিয়ে পড়ে। তখন ডেড সিটি বলা হয় শটরটাকে। তবে জেগে থাকে এই ক্যাফেটা। রাতভর হৈ–হুল্লোড়ে মেতে থাকে মানদালা। এই ক্যাফে কখনোই ঘুমায় না।
কিন্তু, এলা গ্যাপ হোটেলে রাত নামে। আবার সকাল হয়। ফের শুরু হয় পথচলা। গতকাল আদম পাহাড় থেকে পাহাড়ের গায়ে যে ঝুলন্ত রাস্তাটা দেখা যাচ্ছিলো, সেই রাস্তা বেয়েই এগিয়ে চলে ট্যুরিস্ট বাস। উল্টোদিকের ছোট আদম পাহাড়টা যেনো আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে।
মিনিট দশেকের মধ্যে হাতের ডানে উদয় হয় রাবণ প্রপাত। পাহাড়ের মেটে চুড়োটাকে নিচ থেকে মনে হয় আকাশের গায়ে সেঁটে থাকা কোনো স্পট। তার নিচে সবুজ পাহাড় চিরে ধাপে ধাপে নেমে এসেছে ঝরনাটা। বিভিন্ন আকারের বোল্ডারের কারণে এ ঝরণায় নাওয়া বারণ। তবে কোনো কেনো দশনার্থী পাহাড় বেয়ে উঠার চেষ্টা করছে, কিছুটা উপর থেকে ঝরনাটাকে দেখবে বলে।
স্থানীয় কিংবদন্তি বলছে, হরণের পর এখানেও, ঘন গাছপালায় আচ্ছাদিত এই ঝরনার পেছনে সীতাকে কিছু দিন লুকিয়ে রেখেছিলেন রাবণ।
যদি তাই হয়, তাহলে গতকাল দেখে আসা সীতা এলিয়ার মন্দিরটিতে তাকে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো বলা হচ্ছে কেনো?

রাবণ প্রপাত
স্থানীয় এক ভক্ত এর একটা সুন্দর ব্যাখ্যা দেন। নিরাপত্তাজনিত কারণে সীতাকে সবসময় একই স্থানে রাখেননি রাবণ। পর্যায়ক্রমে তাকে বিভিন্ন স্থানে লুকিয়ে রাখা হয়েছিলো। এই রাবণ প্রপাতের পেছনের গুহা সেগুলোরই একটা।
একসময় এ স্থানটা ছিলো ঘনবনে আচ্ছাদিত গোপন আস্তানা। কিন্তু এই ঝরনা এখন আর দুর্গম কোনো স্থান নয়। বরং শ্রীলংকার সহজগম্য ট্যুরিস্ট স্পটগুলোর একটা। হাইওয়ে থেকেই দিব্যি দেখা যায়।
লেখক: প্রধান বার্তা সম্পাদক, দৈনিক আমাদের বার্তা ও নির্বাহী সদস্য, বাংলাদেশ ট্রাভেল রাইটার্স এসোসিয়েশন