আলো ঝলমলে মস্কো

আলো ঝলমলে মস্কো
তাশিক আহমেদ

ভ্রমণপিপাসু পর্যটকরা রাশিয়া গেলে প্রথমেই মস্কো শহরটিকে ঘুরে দেখার জন্য বেছে নেন। এই শহরে রয়েছে অসংখ্য আকর্ষণীয় স্থান যা পর্যটকদেরকে আকৃষ্ট করে।

মস্কো রাশিয়ার রাজধানী এবং ইউরোপ মহাদেশের ঐতিহাসিক শহর। এটি তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়নেরও রাজধানী ছিল। মস্কোভা নদীর তীরে অবস্থিত এই শহরে বিখ্যাত ক্রেমলিন এবং রেড স্কোয়ার অবস্থিত। দর্শনার্থীদের জন্য নির্ধারিত মূল্যের টিকেটের বিনিময়ে ক্রেমলিন ঘুরে দেখার ব্যবস্থা রয়েছে। তবে টিকেটের মূল্য অনেক বেশি, এক্সপেনসিভ। ক্রেমলিন ঘুরে দেখতে হলে বাংলাদেশী টাকায় সাতহাজার টাকা গুনতে হবে একজন পর্যটককে। তবুও এখানে দর্শনার্থীদের উপচে পড়া ভিড় থাকে।

ক্রেমলিন একধরণের দেয়াল দ্বারা সুরক্ষিত স্থাপনা বিশেষ যা রাশিয়ার ঐতিহাসিক শহরগুলোতে অবস্থিত। ক্রেমলিন বলতে অনেক সময় ক্রেমলিনসমূহের মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত অর্থাৎ মস্কো ক্রেমলিনকে বুঝানো হয়। মস্কো ক্রেমলিন হলো রাশিয়ার রাষ্ট্রপতির দাপ্তরিক বাসভবন যা রেড স্কোয়ার  বা মস্কোর লাল চত্ত্বরে অবস্থিত। এটিই ক্রেমলিনকে পৃথক করছে যা বর্তমানে রুশ রাষ্ট্রপতির বাসভবন হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। ঐতিহাসিকভাবে এটি কিতে-গোরোদ বা চীন শহর নামে ব্যবসায়িক কেন্দ্রস্থল। মস্কোর চতুর্দিকে সকল রাস্তার মিলনস্থল। প্রায়শই এটি মস্কো তথা রাশিয়ার কেন্দ্রীয় চত্ত্বর হিসেবে পরিগণিত হয়। রাশিয়ার অত্যন্ত জনপ্রিয়স্থান হিসেবে এটি ব্যাপকভাবে পর্যটন আকর্ষণে সক্ষমতা অর্জন করেছে। এখানে আসলেই পর্যটকদের ভীড় লক্ষ্য করা যায়। যোসেফ স্টালিনের মরদেহ রেড স্কয়ারের কাছাকাছি সংরক্ষণ করা ছিল। লেনিনের মরদেহও সেখানেই ছিল কিন্তু পরবর্তীতে তা স্থানান্তরিত হয় এবং ক্রেমলিন প্রাচীরের কাছে কোনরূপ আনুষ্ঠানিকতা ছাড়াই সমাহিত করা হয়। এই সমাধিস্থলও ভ্রমণবিলাসীদের আকর্ষণ করে।

মস্কো শহরে ১৯৮০ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক গেমস অনুষ্ঠিত হয়। আধুনিক অলিম্পিক গেমসের অধিকাংশ আসরেই বিভিন্ন সময় আলাদাআলাদা জাতি হিসাবে অংশগ্রহণ করেছে। প্রথম রুশ সাম্রাজ্যের অধীন ১৯০০ গেমসে অংশগ্রহণ করে। ১৯০৪ সালের গেমসে অংশগ্রহণ না করলেও ১৯০৮ এবং ১৯১২ গেমসে পুনরায় ফিরে আসে। ১৯১৭ সালে রুশ বিপ্লব সংঘটিত হয় এবং ১৯২২ সালে সোভিয়েত ইউনিয়ন গঠিত হয়। রাশিয়া সোভিয়েত ইউনিয়নের অধীন ১৯৫২ অলিম্পিকে প্রথম অংশগ্রহণ করে। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতন হলে রাশিয়া সমন্বিত দলের অংশ হিসাবে ১৯৯২ গেমসে অংশগ্রহণ করেছিল। রাশিয়া প্রথম স্বাধীনভভাবে অংশগ্রহণ করে ১৯৯৪ শীতকালীন অলিম্পিকে। রুশ ক্রীড়াবিদগণ গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকে ৩৭৯টি পদক এবং শীতকালীন অলিম্পিক গেমসে ১২৪টি পদক জিতে নিয়েছে।

সেবছর বিশ্বকাপ ফুটবল আয়োজন করে রাশিয়া। এ পর্যন্ত বিশ্বকাপ ফুটবলের যতো আসরের আয়োজন করা হয়েছে তারমধ্যে সেরা বিশ্বকাপ বলে মন্তব্য করেছেন ফিফা প্রধান জিয়ান্নি ইনফান্তিনো। ১৪ জুন জমকালো উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’র ২১তম আসরের পর্দা উঠে রাশিয়ার রাজধানী মস্কোর লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। ১৫ জুলাই বাংলাদেশ সময় রাত ৯টায় রাজধানী মস্কোতে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে ক্রোয়েশিয়ার ফাইনাল ম্যাচের মধ্যে দিয়ে শেষ হয় ২০১৮ বিশ্বকাপ আসর। এর আগ মুহূর্তে জ্বলজ্বলে ও মানসম্পন্ন ফুটবলের আয়োজন করায় রাশিয়াকে সবার চেয়ে এগিয়ে দিয়ে আয়োজনকারীদের ধন্যবাদ জানান ফিফা প্রধান।

রাশিয়া ভ্রমণে এসে বিখ্যাত সব স্টেডিয়াম দেখার লোভ সামলানো যায়না। ভ্রমণের এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছালাম লুঝনিকি স্টেডিয়ামে। এটি মস্কোর সর্ববৃহৎ স্টেডিয়াম। স্টেডিয়ামের মোট আসনসংখ্যা ৭৮,৩৬০। লুঝনিকি অলিম্পিক কমপ্লেক্সের অংশ এটি। মস্কো শহরের খামোভনিকি জেলায় এর অবস্থান। মস্কোভা নদীর বাঁকে জন্মানো সুগভীর তৃণক্ষেত্র থেকে ‘লুঝনিকি’ নামটির উৎপত্তি ঘটেছে।

পর্যটকদের কাছে লোভনীয় স্থান হলো মস্কোর ঘন্টা। এটি বিশ্বের প্রাচীন সপ্তাশ্চর্যের একটি। স্থাপনাটি মস্কোর ক্রেমলিনের ইভান গ্রেট বেল টাওয়ারের অনতিদূরে অবস্থিত। অনেকে এটাকে মস্কোর ঘন্টা বলে জানে। তবে এটা ‘জার বেল’ নামেও পরিচিত। দৃষ্টিনন্দন স্থাপনাটির কাছে গেলে চোখ জুড়িয়ে যায়।

বেশ কয়েক বছর আগে যারা মস্কো শহরটি দেখেছেন এখন তার সাথে মিল খুজে পাওয়া ভার। আমি ১৯৯৪ সালে প্রথমবার যে মস্কো শহর দেখেছি এখন তা পুরোপুরি পাল্টে গেছে। সম্পুর্ন নতুন সাজে সেজেছে মস্কো। আইন এর মধ্যেই বসবাস। শহরের সবকিছুই চলছে নিয়মতান্ত্রিকভাবে। অনিয়ম বলে এখানে কোন কিছুই চোখে  পড়ে না। মস্কোর বাসিন্দারা ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডার চেয়ে কোন অংশে কম সুবিধা ভোগ করেন একথা বলা যাবেনা। কেননা মস্কো এখন ইউরোপ, আমেরিকা বা কানাডার সমতুল্য। দিনের মস্কো থেকে রাতের মস্কো শহর আরো বেশি আকর্ষণীয়। রাতের বেলা পুরো শহর থাকে আলোকিত। শহরের প্রতিটি রাস্তাতেই রয়েছে পর্যাপ্ত আলোর ব্যবস্থা এতে করে রাতের বেলাতেও ঘুরে বেড়িয়ে মনে হয় দিনের আলোতেই রয়েছি। শুধু শহরের ভেতরেই নয় হাই ওয়েতেও রয়েছে প্রচুর আলোর ঝলকানি।

মস্কোর আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো মস্কো সার্কাস। মস্কো সার্কাস হলো পৃথিবী বিখ্যাত। যা নিজ চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যাবেনা। বিখ্যাত এই সার্কাস একসঙ্গে ১০ হাজার দর্শক উপভোগ করতে পারেন। সার্কাস দলের সদস্যদের মনোমুগ্ধকর পরিবেশনা দেখতে দেখতে কখন যে সময় পেরিয়ে যায় তা বোঝাই যায় না। মস্কোর আরো একটি বিখ্যাত স্থাপনা হলো বালসই থিয়েটার। এটি পৃথিবীর সবচাইতে বড় থিয়েটার হল। এই মিলনায়তনটি এতটাই বড় যে দর্শকদের চোখে দূর্বিন লাগিয়ে পারফরম্যান্স দেখতে হয়।

মস্কোর বর্ণনা শুনে যারা শহরটি দেখার পরিকল্পনা করবেন তাদেরকে অবশই হাতে পর্যাপ্ত সময় নিয়ে আসতে হবে। কেননা দর্শনীয় এবং পৃথিবী বিখ্যাত পর্যটন স্থান এবং স্থাপনাগুলো ঘুরে দেখতে হলে প্রয়োজন পর্যাপ্ত সময়। মনোমুগ্ধকর শহর আর আকর্ষণীয় পর্যটন নিদর্শন দেখতে দেখতেই পেরিয়ে যাবে দিন। আর মস্কো ভ্রমণের রেশ কাটতে পেরিয়ে যাবে কয়েক মাস।

 লেখক: উর্ধতন কর্মকর্তা, প্রগ্রামবিভাগ, এটিএন বাংলা টেলিভিশন

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »
error: Content is protected !!