
আত্মপরিভ্রমণ
জন্মগ্রহনের মাধ্যমে মানুষ পৃথিবীতে যে ভ্রমণ শুরু করে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তা চলমান থাকে। একজন নবজাতক ক্রমেই শিশু হয়ে ওঠে, শিশু কৈশোরে অবতীর্ণ হয়, কৈশোর থেকে যৌবনে পদার্পন করে…এভাবে জীবনের প্রতিটি ধাপে শরীরের সাথে তার মনেরও একধরণের ভ্রমণ চলতে থাকে। অর্থাৎ ভ্রমণ কেবল নিছক কোনো স্থানে যেয়ে স্বশরীরে ঘুরে বেড়ানোর মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। জগতের অন্যতম শ্রেষ্ঠগ্রন্থ ‘মকতুবাত’ বলে ‘আত্মপরিভ্রমণ করো’। প্রকৃতপক্ষে মানুষের জীবনের সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভ্রমণ হলো ‘আত্মপরিভ্রমণ’। অর্থাৎ নিজের অন্তর্জগতে ভ্রমণ করা। আত্মপরিভ্রমণ মানুষকে ‘মানুষ’ হয়ে উঠতে সাহায্য করে। ‘মানুষ’তো একটি হয়ে উঠবার ব্যাপার। আত্মপরিভ্রমণের নিয়মিত বিভাগে আমাদের আজকের আয়োজন ‘ঘড়ি চুরি থেকে শিক্ষক’।
এক যুবক একজন বৃদ্ধের সাথে দেখা করে জিজ্ঞাসা করলো, আপনি কি আমাকে চিনতে পেরেছেন?
বৃদ্ধ বললেন, না, আমি দুঃখিত, মনে করতে পারছি না।
তারপর যুবকটি বললেন, আমি আপনার ছাত্রদের একজন ছিলাম।
বৃদ্ধ শিক্ষক হেসে জিজ্ঞাসা করলেন,– ওহ সত্যি তাই? তুমি এখন কী করো?
যুবকটি উত্তর দিল, – আমি শিক্ষক হয়েছি। শিক্ষকতা করছি।
একজন শিক্ষক? আমার মতো? বৃদ্ধ জিজ্ঞাসা করলেন।
হ্যাঁ। আর আসলে, আমি আপনার কারণেই শিক্ষক হয়েছি। আপনিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছেন।
বৃদ্ধ অবাক হয়ে জিজ্ঞাসা করলেন,– সত্যিই? কোন মুহূর্ত থেকে তুমি এমন সিদ্ধান্ত নিয়েছা?
এবার যুবকটি তাকে এই গল্পটি বলতে শুরু করলো, একদিন আমার এক বন্ধু একটি নতুন ব্রান্ডের হাতঘড়ি পরে স্কুলে এসেছিল। সেটি খুব সুন্দর ছিল, এবং আমার খুবই মন চাইছিলো ঘড়িটি আমি পরি, আমারও ঐরকম একটি ঘড়ির খুব শখ। তাই আমি তার পকেট থেকে এটি বের করে লুকিয়ে ফেলেছিলাম।
কিছুক্ষণ পরেই, ছেলেটি, মানে আমার ঐ বন্ধু লক্ষ্য করলো তার ঘড়িটি হারিয়ে গেছে। সে আপনাকে বললো, আর আপনি ক্লাস বন্ধ করে দিলেন।
আপনি বলেছিলেন, এই ক্লাস থেকে কেউ একটা ঘড়ি চুরি করেছো। দয়া করে এটা ফেরত দাও।
আমি এটা ফেরত দেইনি কারণ আমি স্বীকার করতে চাইনি যে আমি এটা নিয়েছি।
তাই, আপনি দরজা বন্ধ করে সবাইকে দাঁড়িয়ে থাকতে বললেন। আপনি বলেছিলেন যে ঘড়িটি না পাওয়া পর্যন্ত আপনি আমাদের সবার পকেট তল্লাশি করবেন। আপনি প্রথমে সবাইকে চোখ বন্ধ করতে বললেন যাতে কেউ জানতে না পারে যে কে এটা নিয়েছে।
আমরা সবাই চোখ বন্ধ করেছিলাম। আপনি পকেট থেকে পকেটে ঘুরতে শুরু করেছিলেন। যখন আপনি আমার কাছে এসেছিলেন, আপনি ঘড়িটি খুঁজে পেয়েছিলে। কিন্তু আপনি সেখানেই থামেননি। আপনি সবার পকেট তল্লাশি করতে থাকেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে, এখন চোখ খুলতে পারো। ঘড়িটি খুঁজে পাওয়া গেছে।
আপনি কখনও বলেনওনি কে এটা নিয়েছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ যে আপনি কখনও আমার দিকে অন্যভাবে তাকানওনি। আপনি কাউকে বলেননি। আপনি আমাকে রক্ষা করেছিলেন। সেটা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে লজ্জাজনক মুহূর্ত, কিন্তু সেদিনই আপনি আমাকে বাঁচিয়েছিলেন। আপনি আমাকে দেখিয়েছন লজ্জা দিয়ে নয়, দয়া দিয়ে কাউকে সংশোধন করার অর্থ কী।
সেই দিন থেকে, আমি আপনার মতো হতে চেয়েছিলাম। সেই কারণেই আমি শিক্ষক হয়েছি। আপনার কি সেই দিনটির কথা মনে আছে স্যার?
শিক্ষক ধীর গলায় বললেন, আমার চুরি করা ঘড়িটির কথা মনে আছে, আর আমি এটি খুঁজছিলাম বলে মনে আছে… কিন্তু তোমার কথা মনে নেই। কারণ আমি নিজেও চোখ বন্ধ করেছিলাম।
মামুন ইকবাল