

ফ্রান্স হচ্ছে উৎসবের দেশ। সারাবছর ধরে গোটা দেশজুড়ে পালিত হয় অসংখ্য উৎসব। ঐতিহাসিক উৎসব যেমন আছে, তেমনি আছে উচ্ছল নির্মল আনন্দ উদযাপনের বহু উপলক্ষ। আপনি যদি ফ্রান্সে বসবাস করে থাকেন তাহলে ফরাসি ইতিহাস-ঐতিহ্যে ঠাসা এসব উৎসবগুলো আবিষ্কার করতে পারেন কোনো ছোট্ট শহরে বা উপভোগ করতে পারেন বড় নগরে যেয়ে। ফরাসি জাতির কৃষ্টি, সংস্কৃতিকে বোঝার জন্য এই রঙিন উৎসবগুলোর সাথে নিজেকে যুক্ত করার বিকল্প নেই। ফ্রান্সের সেরা উৎসবগুলো হতে পারে ঘুড়ি উড়ানো থেকে লেবুফলের কিংবা অপেরা থেকে আলোক সজ্জার উৎসব। তারই সেরা ১০ উৎসব তুলে ধরা হলো এখানে।

ঘুড়ি উৎসব
বিশালাকার শুকর, কাকড়া, তিমি, টিকটিকি, বহুবর্ণের কার্টুনের নানা চরিত্র সবই আকাশে উড়তে পারে ব্যারক স্যুর ম্যার আন্তর্জাতিক ঘুড়ি উৎসবে। এই উৎসবে আপনি উপভোগ করতে পারবেন বিশ্বের নানাপ্রান্ত থেকে আসা প্রতিযোগিদের দুর্দান্ত ঘুড়ি উড়ানোর কৌশল, যারা আকাশে শুধু বাতাসের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে না, অন্য প্রতিযোগিদের সাথেও লড়াইয়ে ব্যস্ত থাকে।

মেন্টন লেবু উৎসব
প্রতিটি বসন্তে দুই সপ্তাহের জন্য মেন্টন শহর ভরে যায় কমলাসহ নানারকম লেবুর সমাহারে। সেই সময়কে সিতে দে সিটভা বা লেবুর শহর বলা হয়। রাতদিন সেইসময় বহু ফল নিয়ে নানারকম প্যারেডের আয়োজন চলে। বায়োভেস গার্ডেনে ১০ মিটার উঁচু ফলের মূর্তি তৈরি করা মডেলস্বরূপ। স্থানীয়ভাবে তৈরি জুস, সাবান, পারফিউম বিক্রয় করা হয়; বলাবাহুল্য এইসব কিছুই লেবু দিয়ে তৈরি।

আভিনিঞ (Avignon) এর উৎসব
আভিনিঞ শহরের ঐতিহাসিক ‘পোপ প্যালেস’ বা পোপের প্রাসাদের আঙ্গিনায় মিউজিকাল বা থিয়েট্রিকাল প্রডাকশনের ফ্রেঞ্চ বা ওয়ার্ল্ড প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়। ১৩০৯-১৩৭৭ সাল পর্যন্ত রোম থেকে নির্বাসনকালে এখানেই পোপের আবাস ছিলো। এখানে পাশাপাশি একই সাথে দুটি উৎসব চলে। একটি ‘IN’ নামে পরিচিত, অন্যটি ‘OFF’, যেখানে স্বাধীনভাবে অন্য থিয়েটার কোম্পানীগুলোও তাদের উৎসব পরিচালনা করে।

বাস্তিল দিবস-১৪ জুলাই
ফ্রান্সের সবচেয়ে বড় এবং গুরুত্বপূর্ণ উৎসব হচ্ছে বাস্তিল ডে ১৪ জুলাই। ফরাসি বিপ্লব স্মরণে অনুষ্ঠিত এই দিনে নানাবিধ আয়োজন থাকে, যার মধ্যে প্যারেড, আতশবাজি, কনসার্ট, অন্যতম। আতশবাজিসহ আরো কিছু অনুষ্ঠান বিশেষভাবে উপভোগ করার জন্য আইফেল টাওয়ার কিংবা প্যারিসের সবচেয়ে উঁচু ভবন মমপার্নাস টাওয়ারের ওপরেও মানুষ হাজির হয়।
এই দিনের জন্য বিদেশি দর্শক বা পর্যটকরাও কিছু ফরাসি শব্দাবলী উচ্চারণ করে থাকে, যেমন ঠরাব খধ ঋাধহপব (ফ্রান্স দীর্ঘজীবী হোক) কিংবা ইড়হহব ভবঃব! (শুভ্র ছুটির দিন)।

কান চলচ্চিত্র উৎসব
চলচ্চিত্র প্রেমিকদের সবচেয়ে কাঙ্খিত উৎসব হচ্ছে ফ্রান্সের কান চলচ্চিত্র উৎসব, যেখানে তাবৎ দুনিয়ার চলচ্চিত্র পরিচালক অভিনেতারা সমবেত হয়, একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করেন অত্যন্ত সম্মানজনক Palme d’Or পুরস্কার জয়ের জন্য।
বেশিরভাগ ছবিকে শুধুমাত্র আমন্ত্রণ জানানো হয়, তবে হতাশ হওয়ারও কারণ নেই বীচ সংলগ্ন এলাকায় ব্যাপকভাবে সিনেমা প্রদর্শনের উন্মুক্ত সুযোগ রয়েছে। কান উৎসবে আসা দেশ বিদেশের ছবিগুলো সেখানে দেখানো যায়। কান উৎসবের টিকেট কেনা যাবে কান টুরিস্ট অফিস থেকে।

নিস কানির্ভাল
জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি এই সময়ে ফ্রেঞ্চ রিভেইরা অঞ্চলে বছরের প্রথম হলুদ মিমোসা ফুল ফোটে। ফ্রান্সের গ্রামগঞ্জে সোনালি হলুদ এই ফোটা ফুলের মেলা যেন চোখে ধাঁধা লাগায়। মিমোসার মৃদু মিষ্টি গন্ধ ঘোর লাগায়। তাই বেশিরভাগ মিমোসা ফুলের চাহিদা ফ্রান্সের পারফিউম গ্রাম গ্রাসে। দীর্ঘ শীতের ধূসরতা কেটে গিয়ে ফ্রেঞ্চ রিভেইরা উজ্জ্বল হলুদ হয়ে ওঠে এই মিমোসার আগমনে। আর সেই মিমোসার পথ ধরে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি ফ্রান্সের সমুদ্র শহর নিস সেজে ওঠে ফুলের উৎসব- Carnival de Nice-এর জন্য।
ফুল উৎসবের শুরু হয় মিমোসা রানি নির্বাচন করে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কার্নিভালগুলোর মধ্যে অন্যতম নিসের এই কার্নিভাল। কয়েক লাখ মানুষ এই কার্নিভাল উপলক্ষে এখানে আসে। নিস জমজমাট হয় এই কার্ন্যািল ঘিরে, এই ফুলের প্যারেড ঘিরে। এই কার্নিভালের সূচনা ঠিক কবে জানা নেই। তবে ইতিহাসের পাতা ধরে পিছিয়ে গেলে জানা যায়, এই কার্নিভ্যাল হয়তো বা শুরু হয়েছিল ১২৯৪ সালে। তবে ফুলের এই কার্নিভাল প্রথম হয় ১৮৭৬ সালে।

Choregies d’Ovange
অরেঞ্জ শহরের রোমান থিয়েটার যেটিতে বসবার জন্য রয়েছে আধা বৃত্তাকার পাথর এবং শাব্দিক পাথুরে মট ও দেওয়াল, নি:সন্দেহে এটিকে বিশ্বের অন্যতম উন্মুক্ত নাট্যমঞ্চ হিসাবে খ্যাতি এনে দিয়েছে। প্রতি গ্রীষ্মেই খ্যাত-সখ্যাত, জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক বহু অপেরা তারকা এখানে উৎসবে মেতে উঠেন। কেউ যদি অপেরা ভক্ত নাও হন, এখানকার এই উৎসব না দেখে থাকলে মিস করবেন।

সেডানের মধ্যযুগের উৎসব
সেডানের এই মধ্যযুগীয় দুর্গটি ইউরোপের মধ্যে বৃহত্তম। সাততলা উঁচু এই দুর্গের আয়তন ৩৫০০০ স্কয়ার মিটার, যেখানে অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে যেতে হয়। সেডানের এই দুর্গ প্রাঙ্গনেই প্রতি বছর মে মাসে অনুষ্ঠিত হয় মধ্যযুগীয় উৎসব। সেসময়ে জীবন কেমন ছিলো, সেসময়ের পোষাক আষাক, মানুষের চাল-চলন, আনন্দ-উল্লাস, খেলাধুলা, তলোয়ার, কুস্তি ইত্যাদি কেমন ছিলো এই উৎসবে এলে যেন সেই সময়ের জীবনে ফেরার একটি অভিজ্ঞতা পাওয়া যায়।

বিশ্বসঙ্গীত উৎসব
জুন মাসের ২১ তারিখের দীর্ঘতম দিনটি গোটা ফ্রান্সের বাতাসে উড়তে থাকে সঙ্গীতের মূর্ছনা। যেটি খধ ঋবঃব ফব খধ গঁংরয়ঁব নামে বিখ্যাত। এই দিনটিতে ঘরে বাইরে, পথে, পার্কে, রেস্টুরেন্ট কিংবা বারে, যাদুঘর বা কনসার্ট হল সবখানে পেশাদার অপেশাদার সকলেই সঙ্গীতে মেতে থাকেন, হোক সেটা গাওয়া বা শোনা কিংবা দেখা; যেকোনো দর্শকের জন্য এই দিনের উৎসব একদম ফ্রি। যে কেউ চাইলে নিজের কোনো সঙ্গীতযন্ত্র নিয়ে কিংবা গান গাওয়ার জন্য কিংবা শুধু উপভোগ করারবার জন্য উৎসবে শামিল হতে পারেন।

লাইট উৎসব
ডিসেম্বর মাসের শুরুতে চারদিনব্যাপী লাইট উৎসবে লিও শহর হয়ে উঠে সত্যিকারের ‘সিটি অফ লাইট’ যেটিকে জাদুময় আলোকসজ্জাও বলা হয়। হাজার হাজার প্রজ্জলিত মোমবাতি শহরের বাড়িঘরগুলোর ব্যালকনি এবং জানালায় জলতে দেখা যায়।
শহরের ভবন এবং ব্রীজগুলো সেজে উঠে বহু রঙের উজ্জল আলোতে। পৃথিবীর নানা দেশ থেকে শিল্পীরা সংযোগ করেন তাদের বর্ণিল আলোকবাতি। প্রচুর ভিড় হয় এই উৎসবে। বলা হয়ে থাকে চারদিনে ৪০ লক্ষ মানুষ এতে অংশ নেয়।
মালিক আনোয়ার এলাহী চৌধুরি