শুধু আনন্দময় নয়, উপভোগ্য ‘প্যারিসের পথে পথে’..

ব্রুনো প্লাজ

১৮ শতকের জগদ্বিখ্যাত ফরাসি লেখক শার্লস দ্য মঁতেস্কু তার  ‘পেরিজিয়ান লেটার্স’ বইটির পাতায় পাতায় মেলে ধরেছেন ফ্রান্স ভ্রমণের রোমাঞ্চকর আবিষ্কারের ইতিবৃত্ত, অনেকটা বিদেশি ভ্রমণকারীদের জুতো পায়ে গলিয়ে স্বয়ং পুরো ফ্রান্স চষে বেড়িয়েছেন। সেই বইয়ের দুই উল্লেখযোগ্য চরিত্র ছিলো ‘উসবেক’ ও তার তরুণ বন্ধু ‘রিকা’। এই দুই নবীন ‘পেরিজিয়ান’ তাদের মায়াবী চোখে দেখা ফ্রান্সের অবিকল প্রতিচ্ছবি একেছিলেন। তাদের সতেজ ঝকঝকে চোখগুলো ছিলো সীমাহীন কৌতুকে ভরপুর। পাশ্চাত্যের জীবনশৈলী ও রহস্যময়তার যে ব্যাপারগুলো তাদেরকে হতবাক বা বিস্মিত করেছিলো সেসব বিষয়গুলো তুলো ধরার ক্ষেত্রে তারা বিশেষ জোর দিয়েছিলেন; যেমন ফরাসি রীতিনীতি বা প্রথা, বৈশিষ্ট্য, সামাজিক ধরন, সাজসজ্জা, ফরাসি জনগণের যাপিত জীবনের আদ্যোপান্ত জেনে প্রাচ্যবাসী এই দুজনই অন্তরে-বাহিরে হয়ে পড়েন পুরোপুরি বিস্ময়াভিভূত। 

‘পেরিজিয়ান লেটার্স’ প্রকাশের তিন শতাব্দী পরে আবু সুফিয়ান ও তার স্ত্রী সাবৃনার প্যারিস ভ্রমণের বৃত্তান্ত ‘প্যারিসের পথে পথে’ (ইন দ্য স্ট্রিটস অব প্যারিস) প্রকাশিত হয়েছে, যা ২০০০ সালে তাদের সঙ্গে আমাদের ভালোবাসার নগরী প্যারিসের পথ থেকে পথে ভ্রমণসঙ্গী হওয়ার অভূতপূর্ব সুযোগ এনে দিয়েছে। এই ভ্রমণবৃত্তান্তটি মঁতেস্কুর সেই অমর সৃষ্টির মতো সবার নাগালে হয়তো পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু শীতের চাদরে মোড়ানো প্যারিস আবিষ্কারে দুজন বাংলাদেশির প্রাণান্তকর প্রচেষ্টার নান্দনিক কথামালা ছবির মতো সুন্দর ও সুশোভিতভারে তুলে ধরা হয়েছে।

সুফিয়ান দম্পতির প্রথম প্যারিস ভ্রমণের অভিজ্ঞতার পুরোটাই ‘মন-মাতানো আনন্দে’ ভরপুর ছিলো, এমনটা বলা যাবেনা। কিন্তু সেখানকার সমৃদ্ধ ঐতিহ্য ও বৈচিত্র্যময়তার মুখোমুখি হওয়ার অনুপম অভিজ্ঞতার সম্মুখিন হয়ে যে অসাধারণ সব ঘটনা ও অনুভূতির সাক্ষী হয়েছেন, সেগুলো দুজনের হৃদয়পটে চিরভাস্মর হয়ে থাকবে।

প্যারিসের অনেক কিছুতেই আজ বহুব্যবহারে পড়েছে জীর্ণতার ছাপ। কিন্তু এক নজরেই টের পাওয়া যায় সেগুলো গভীর আন্তরিকতার সঙ্গেই পুরোনো ঐতিহ্যের সাক্ষ্য বুকে বহন করে চলেছে। ‘আইফেল টাওয়ার’ এই আলোর নগরীর অপরিহার্য বাতিঘর; ‘পিগালে’ রাতভর চলে হইহুল্লোড় ও উদ্দামতা, আর ‘মোঁমার্ত’ এলাকায় আজও আমেলি পলিনকে স্বাগত জানানো হয়নি–সেই ঘটনাও এই ভ্রমণবৃত্তান্তে চমৎকারভাবে তুলে ধরা হয়েছে।

‘প্যারিসের পথে পথে’ বইটি পড়ার মজা হলো এই বই আমাদের হারিয়ে যাওয়া এক অতীতকালে নিয়ে হাজির করে, যেখানে ফরাসি মুদ্রা ছিল ফ্রা, যেখানে খুব কম সংখ্যক ফরাসিই ইংরেজি বলতে পারতেন। তখন সেখানে পাড়ি জমানো আরবদের একটি বড় অংশকেই ‘চোর’ হিসেবে বিবেচনা করা হতো, সেখানকার জাদুঘরগুলোর প্রবেশপথে তখন সদ্য বসেছে মেটাল ডিটেকটর এবং চার্লস দ্য গল বিমানবন্দর ও প্যারিসের মাঝের রাস্তায় চালু হয়েছে ঘণ্টায় ১৫০ কিলোমিটার গতিতে ছুটে চলা ট্যাক্সি…

প্রতি মুহূর্তেই বদলে যাচ্ছে বিশ্ব এবং এই ছবিটি নিমিষেই কালের পরিক্রমায় হারিয়ে যাওয়া আনন্দঘন সেই মুহূর্তগুলো আমাদের স্মৃতির আয়নায় প্রতিফলিত করে, সব-ই সিনেমার মতো ভাসতে শুরু করে চোখের সামনে; পুরোনো নয়, যেন এ সবকিছুই বাস্তব! আবু সুফিয়ানের বইটির পরতেপরতে এমন জীবন্ত সব চিত্র ফুটে উঠেছে।

সুইস ভ্রমণকাহিনী লেখক নিকোলাস বোভিয়েরের মতে, ‘ভ্রমণ মাত্রই এর উদ্দেশ্যকে অগ্রাহ্য করে। এটি খুব শিগগিরই যথাযথভাবেই নিজেকে প্রমাণ করে। আপনি ভাবতে শুরু করেন যে আপনি কোথাও ভ্রমণে রয়েছেন, কিন্তু শিগগিরই এটি আপনাকে নিজ নিয়ন্ত্রণে নিয়ে যায়; অথবা আপনিই নিজেকে প্রকাশ করতে শুরু করেন।’

আবু সুফিয়ান উদারতা ও অনুসন্ধিৎসা নিয়ে ভ্রমণ করেন। তার হৃদয় সর্বদাই অজানাকে জানতে উন্মুখ। তার সঙ্গে ভ্রমণ শুধু আনন্দময় নয়, দারুণ উপভোগ্য। সেজন্যই তার প্যারিস ভ্রমণ নিয়ে লেখা বইটি মনোযোগের সঙ্গে পড়তে শুরু করলেই আপনি সেখানে গিয়ে হাজির হবেন এবং বাস্তবিকই মিলবে রোমাঞ্চকর এক ভ্রমণের পরিতৃপ্তি!

(প্যারিসের পথে পথে বইয়ের ইংরেজি সংস্করণ এর ভূমিকা থেকে অনুবাদ করেছেন অদ্বিতী আহমেদ)

লেখক : পরিচালক, আলিয়স ফ্রসেজ ঢাকা (২০১৮)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!