
স্পিরিচুয়াল বা আধ্যাত্মিক ভ্রমণ স্বাভাবিক ভ্রমণের মতো নিয়মিত ঘটনা নয়। এই ভ্রমণ বিশেষ বৈশিষ্টপূর্ণ, মর্যাদাময় এবং দারুণ আকর্ষণীয়। ‘ভ্রমণে’র এই বিভাগে পৃথিবীর কিছু বিখ্যাত স্পিরিচুয়াল ভ্রমণকাহিনী পাঠকের জন্য তুলে ধরা হয়েছে।
খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী র. এর জন্ম ১১৭৩ খৃস্টাব্দে। জন্মস্থান সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের ফারগানা ভ্যালি (Fergana Valley)। বর্তমান কিরগিজিস্তান, তাজিকিস্তান এবং উজবেকিস্তানকে নিয়ে মধ্য এশিয়ায় কারগানা ভ্যালির অবস্থান। তিনি ছিলেন জন্মগত সাধুব্যক্তি। জগদ্বিখ্যাত সুফী দরবেশ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী র. এর অত্যন্ত স্নেহভাজন এবং প্রধানতম খলিফা ছিলেন কুতুবুদ্দীন কাকী র.। খাজা মঈনুদ্দীন চিশতী র. এর মৃত্যুর চল্লিশ দিন পূর্বে এই প্রিয়তম শিষ্যকে দিল্লী থেকে আজমীরে ডেকে আনেন এবং আনুষ্ঠানিকভাবে চিশতীয়া তরিকার উত্তরসুরি বা খলিফা হিসাবে ঘোষণা দেন। প্রিয় পীর ও মোর্শেদ মঈনুদ্দীন চিশতী র. এর নির্দেশে কুতুবুদ্দীন কাকী দিল্লীতে বসবাস করতেন। রাজাপ্রজা, ধর্মবর্ণ নির্বিশেষে সব মানুষের ভক্তি ভালোবাসার কেন্দ্রবিন্দুতে ছিলেন খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার কাকী র.। সেসময় ভারতবর্ষে দিল্লীর শাসক ছিলেন সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাস। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাসের শাসনকাল ১২১০ থেকে ৩০ এপ্রিল ১২৩৬ সাল পর্যন্ত। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাসও ভীষণ শ্রদ্ধা, ভক্তি ও ভালোবাসাসহ সপ্তাহে দুইদিন কুতুবুদ্দীন কাকী র. এর সান্নিধ্যে কাটাতেন।
জাতিসংঘের ইউনেস্কো হেরিটেজের অংশ দিল্লীর বিখ্যাত কুতুবমিনার, কুতুব কমপ্লেক্স মহান এই দরবেশ কুতুবুদ্দীন র. এর প্রতি সম্মান ও ভালোবাসা প্রদর্শনের উদ্দেশ্যেই তাঁর নামে নামকরণ করেন সুলতান আলতামাস। সুলতানের অনুরোধ সত্ত্বেও এতকিছুর পরেও কুতুবুদ্দীন কাকী র. দিল্লী শহরে থাকতে রাজী হলেন না।
দিল্লী শহর থেকে বেশ দূরে কেলু খেহরি নামক এক স্থানে তিনি বসতি শুরু করেন। সুলতান আলতামাস সেখানেই সপ্তাহে দুইদিন কুতুবুদ্দীন কাকী র. এর সাথে সাক্ষাত করতে যেতেন। সময় কাটাতে ভালোবাসতেন। প্রাতকালে হাটতে বেরুতেন। এমনি এক সকালে সুলতান এবং কুতুবুদ্দীন কাকী র. হাটতে বেরিয়েছেন। আকস্মিকভাবে এক নারী তাদের পথরোধ করলো। নারীটি সন্তানসম্ভবা। সুলতান শামসুদ্দীন আলতামাসের কাছে ফরিয়াদ করলো তার একটি অভিযোগের ফয়সালা করার জন্য সে এত সকালে সুলতানের পথরোধ করেছে।
আলতামাস ন্যায়পরায়ন শাসক ছিলেন। অভিযোগ কী, জিজ্ঞেস করলেন।
নারী বললো, আমার পেটে যে সন্তান, তার কোনো বৈধ পিতা নেই। আমার এই সন্তান ব্যভিচারের পরিণতি। আমি একজন খারাপ নারী। জানি আামি দোষী। তবে আমার বিচারের আগে সুলতানের কাছে ঐ ব্যক্তির বিচার দাবী করছি যার অবৈধ মিলনের ফলে আজ আমার এই অবস্থা!
সুলতান জানতে চাইলেন কে সেই ব্যক্তি? অবশ্যই তার বিচার করা হবে। ঐ নারীর দিকে তাকিয়ে বললেন, কী নাম তার? কোথায় তার বাস?

খাজা কুতুবুদ্দীন কাকী র. দরগা
নারী জানালো, সে এখানেই আছে।
সুলতান খানিকটা কৌতুহলী হলেন। জানতে চাইলেন, কোথায়?
নারী বললো, উনি আপনার সাথেই আছেন।
সুলতান ঘটনা বুঝতে পারলেন না-সাথেই আছে মানে কী? তিনি ধমক দিয়ে বললেন, তুমি তার নাম বলো। আমি তার উত্তম বিচার করবো। কী নাম তার?
নারী বললো, তার নাম কুতুবুদ্দীন কাকী র.!
সুলতান হতবিহবল হয়ে পড়লেন। এযে অবিশ্বাস্য! কুতুবুদ্দীন কাকী র. মস্ত বড় আউলিয়া, সুফী-দরবেশ। একি অসম্ভব অভিযোগ করলো এই গর্ভবতী নারী!
কুতুবুদ্দীন কাকী র. ও হতবাক হলেন। অস্বস্তি বোধ করছেন। দিল্লীর এই রাস্তায় সুলতানের সাথে তিনি প্রাতভ্রমণ করছিলেন। এই নারীর অভিযোগের বিরুদ্ধে কী বলবেন তিনি? কে সাক্ষ্য দেবে? মনেমনে ভাবলেন, আমার পীর মঈনুদ্দীন চিশতি র. যদি এখন সামনে থাকতেন! অত্যাশ্চর্যভাবে তৎক্ষণাৎ খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি র. এই তিনজনের মাঝে এসে হাজির হলেন। সুলতান আলতামাস খাজা সাহেবকে এভাবে দেখে তাজ্জব বনে গেলেন। দিল্লী থেকে আজমীর অনেক দূর। শ্রদ্ধাবনতভাবে বললেন, খাজা সাহেব আপনি?
মঈনুদ্দীন চিশতী র. বললেন, প্রিয়তমপুত্র কুতুবুদ্দীন বিপদাপন্ন হয়েছে, আমি এটা সইতে পারিনি। সেজন্য তোমার কাছে সত্য বলবার জন্য তোমার সামনে উপস্থিত হলাম। কেননা এখানে কোনো সাক্ষী নেই। তুমি জেনে রাখো ঐ নারী যে অভিযোগ করেছে তা সত্য নয়। কুতুবুদ্দীন পবিত্র।
ঐ নারী এই দৃশ্য দেখে ঘাবড়ে গেলো। সে হাউমাউ করে চিৎকার করে কাঁদতে শুরু করলো এবং ক্ষমা চাইতে থাকলো। বললো, আমি মিথ্যা বলেছি। আমি সুলতানের কাছে কুতুবুদ্দীন কাকী র. এর মতো পবিত্র মানুষের নামে মিথ্যা দোষারোপ করেছি। আমাকে ক্ষমা করুন।
তাকে আটক করা হলো। সুলতান আলতামাস জিজ্ঞেস করলেন, এমন একজন আউলিয়ার নামে এতোবড় মিথ্যা আরোপের দু:সাহস তোমার কেমন করে হলো?
উত্তরে নারী জানালো, আমি একজন ব্যভিচারিণী। পাপিষ্ঠা রমনী। নরক ছাড়া এই পৃথিবী বা পরের পৃথিবীতে আমার কোনো স্থান নেই। আমি দোজখের শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য কুতুবুদ্দীন কাকী র. এর নামে মিথ্যা দোষোরোপ করেছি। আমি ভেবেছি এমন একটি ফাঁদে ফেললেই কেবল উনার সান্নিধ্য আমি পেতে পারি। এই দরবেশ এর ফলে আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হবেন। আর তার স্ত্রী হিসাবে আমি আমার পাপ থেকে মুক্তির সুযোগ পাবো। নরক থেকে বাঁচবো। কুতুবুদ্দীন র. এতই পবিত্র উনার কাছে পৌঁছানোর আর কোনো পথ আমি পাচ্ছিলাম না।
বলে হাউমাউ করে কাঁদতে লাগলো ঐ নারী।
খাজা মঈনুদ্দীন চিশতি র. প্রিয় শিস্য কুতুবুদ্দীনের প্রতি স্বীয় ভালোবাসা দেখিয়ে মুহূর্তেই দিল্লী থেকে আবার আজমীর ফিরে গেলেন। ইংরেজি ১২৩৭ সালে হজরত খাজা কুতুবুদ্দীন কাকী র. ইন্তেকাল করেন। দিল্লীর কুতুব মিনারের নিকটে মহারুলিতে তার দরগা এখনো শত-সহস্র মানুষের ভক্তি ভালোবাসায় মুখর হয়ে থাকে।
শাহাদত ইবরাহিম