ফরাসি পথের সঙ্গীত

প্রতিটি দেশের মানুষের জীবন ধারণ, জীবন-যাপনের এক অতি নিজস্ব ছবি আছে, আছে দৃশ্য, আছে হাসি, আনন্দ, জীবন দর্শনকে ব্যক্ত করার এক নিজস্ব প্রয়াস, নিজস্ব ভঙ্গি, যা নিতান্তই অভিনব। আর সেই দৃশ্যগুলো সময়ের সঙ্গে সঙ্গে খুব ধীরে ধীরে বদলে যায়। জানি না, সেই বদল ভালোর দিকে, না মন্দের দিকে। তবুও সেই দৃশ্যগুলো বদলায়। মানুষও সেই দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গে বদলে যায়। বদলায় না শুধু শহরের ওই ঐতিহাসিক স্থাপত্যগুলো- পাথরে বাঁধানো প্রাচীন গলির চরিত্র, সামারের হলুদ উদাসীন মন কেমনের দুপুরগুলো, রক্তিম বিকেলগুলো, তুষার শীতল সন্ধ্যভগুলো।

গত কয়েক বছর ধরে তুলুসকে নানা রূপে দেখেছি, তুলুসের প্রতিটি গলির মোড় ও স্কয়ারের গন্ধ ও সুরগুলো জেনেছি ধীরে ধীরে। তুলুস, অবশ্য শুধু তুলুস কেন, ফ্রান্সের প্রত্যেকটি জায়গারই দেখেছি একটি সুর আছে, আছে নিজস্ব এক সুবাস, আছে বৃষ্টির সুবাস, বুনো ঝোপে ফুটে থাকা ফুলের মিষ্টি সুবাস, তুষারপাতের সুবাস। আর সুর, সুবাস সব মিলিয়ে ফরাসি জীবনযাত্রার ছবিগুলো তৈরি হয়।

আবার দেখেছি, গ্রামের দিকের ফরাসিরা যেন যুগ বদলের সঙ্গে সঙ্গে বদলাতে জানে না। আজকের আধুনিক গতিময়তা যখন সব সুর-ছন্দের কথা ভুলিয়ে দিয়ে শুধুই ব্যস্ততা ও অতি সক্রিয়তা উপহার দেয়, ফ্রান্সের গ্রাম ও শহরের রাস্তা ও বাজারের এই সঙ্গীত শিল্পীরা যেন সুরের সেই অনাদি তাল-লয়ের আশ্চর্য মহিমাকে মনে করিয়ে দিতেই রাস্তার পাশে বাজাতে ভালোবাসে।

যাওয়া-আসার পথে পথচারীদের দৈনন্দিকতাকে এক টুকরো সুরের ঝংকার, সুরের মাধুর্য উপহার দিতে ভালোবাসে, আর কেউ যদি বা খুশি হয়ে  দু-এক ইউরো দিয়েই দেয়, ক্ষতি নেই। সুর ভালোবাসার নজরানা বলা যায়। সুর বাজানোই এদের মুখ্য উদ্দেশ্য, স্ট্রিট পারফরম্যান্স। আর এই বাজনা বাজানোর দলের মুখগুলোও বদলাতে থাকে।

জানি, সামারের এক নির্জন হলুদ দুপুরে যে লোকটি গাছের ছায়ায় একা নির্জনে বসে বাঁশি বাজিয়ে চলেছিল, কিংবা রেভেল গ্রামের রোববারের বাজারের ওই দম্পতি, যারা সেদিন একমনে বাজারে আসা মানুষদের জন্য সুরের এক মায়াজাল তৈরি করেছিল, যাদের ঘিরে অনেক শ্রোতা ছিল, হয়তো বেশ কয়েক বছর পর আবার সেই জায়গায় গেলে অন্য কাউকে বাজাতে দেখব।

তুলুস বসবাসের একদম প্রথম দিকে আমাদের ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টটি ছিল সিটি সেন্টারে। আর সেই অ্যাপার্টমেন্টের নিচেই গলির মোড়ে বসে প্রতিদিন একজন একমনে Accordion বাজাত। সামারের সন্ধ্যায় সেই সুর ছড়িয়ে পড়ত আমাদের ছোট্ট ঘরে। সেই সুর যেন ফরাসি উপায়ে জীবনকে, পৃথিবীকে গোলাপি কাচের চশমা দিয়ে দেখতে শেখার আহ্বান জানাত। আর ফরাসি পথের ওই টুকরো ছবি, টুকরো সুর যেন জীবনকে ভালোবাসতে, বর্তমানকে মর্যাদা দিতে শেখায়।

মোফাজ্জল চৌধুরি, তুলুস, ফ্রান্স থেকে

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!