
প্যারিস ও রম্যোপন্যাস যেন হাত ধরাধরি করে চলে। ঠিক যেমন: শ্যাম্পেন ও ঝিনুক, ক্যাফে ও ক্রোসোঁয়া (সুন্দর রুটি) এবং জাম্বু (শূকরের মাংস) ও (মাখন)। সেজন্যই প্রতিবছর ‘ভ্যালেন্টাইন্স ডে’ কাটাতে বিশ্বের তাবৎ প্রেমিকজুটির প্রথম পছন্দ ভালোবাসার তীর্থস্থান- ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিস। কিন্তু প্যারিস কি সত্যিই ভালোবাসার শহর?
এক জরিপ অনুসারে, বিশ্বের শীর্ষ ১০টি দর্শনীয় স্থানের তালিকায় সগর্বে জায়গা করে নিয়েছে প্যারিসের দুটি স্থান। এর মধ্যে একটি ডিজনিল্যান্ড প্যারিস। আর দীর্ঘদিন ধরেই ভালোবাসা দিবস বা ভ্যালেন্টাইন্স ডে উদযাপনে নবদম্পতিদের অন্যতম পছন্দের শহর প্যারিস। প্রতিবছরই ঐসময়ে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের নানান বয়সী মানুষ সেখানে ভিড় জমান।
বিশ্বের জমকালো ও বিখ্যাত সব শহর ছেড়ে কোন অমোঘ আকর্ষণে মানুষ ছুটে আসে ফ্রান্সের রাজধানীর পানে? আর এই স্বীকৃতি আসলে কি প্যারিসেরই প্রাপ্য?

অপার সৌন্দর্যের লীলাভূমি
অপরূপা প্যারিস যেন শিল্পীর তুলিতে আঁকা কোন ছবি! চোখ ধাঁধানো এই ছবির প্যারিস নির্মাণের প্রধান যে কারিগর তার নাম জর্জ ব্যারো ওসমান। খ্যাতিমান এই স্থপতির পরিকল্পনাতেই নির্মিত হয়েছে নগরীর দৃষ্টিনন্দন সব মনুমেন্ট ও কমনীয় খোয়া বাঁধানো পথঘাট। নিঃসন্দেহে বর্তমানে বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম প্যারিস। আর এই প্যারিসের তুলনা শুধু প্যারিসই!
ইউনেস্কো স্বীকৃত বিশ্ব ঐতিহ্য স্থানগুলো সুরক্ষায় প্যারিস নগরীতে ভবনের উচ্চতাসীমা ছয়তলা পর্যন্ত বেধে দেয়া হয়েছে। এভাবেই আকাশপ্রান্তের সীমানা সুরক্ষিত রেখে আজও তার রোমান্টিক আবেদন ধরে রেখেছে শহরটি।
এ প্রসঙ্গে প্যারিস-ভিত্তিক লেখক ডেবরা হেলি বলেন, মানুষ বরাবরই ঐতিহ্যের পূজারি; তাই আপনি নিশ্চয়ই নগরীর ঐতিহ্যবাহী পুরোনো ভবনগুলোর চারপাশ ঘিরে সুউচ্চ ভবন তুলে দুর্বোধ্যতার গিরিখাত তৈরি করবেন না। আমি মনে করি, মানুষ (পর্যটক) এখানে আসে নগরীর এই সৌন্দর্যের টানেই।
কোথাও বেড়াতে এসে বাস বা মেট্রোয় চড়ে শহর ঘুরে দেখার চেয়ে দুজনে হাত ধরাধরি করে হেঁটে হেঁটে চারপাশের সৌন্দর্য উপভোগ করাটা অবশ্যই বেশি রোমান্টিক। আর শহরজুড়ে জালের মতো ছড়ানো আঁকাবাঁকা ছোট আকারের চওড়া রাস্তায় দুজনে মিলে হেঁটে বেড়ানো ও আশপাশের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা ও মনোমুগ্ধকর প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের জন্য আদর্শ এক শহর প্যারিস। যেখানে কখনোই হারানোর ভয় নেই এবং সবসময়ই সামনে কাছাকাছি কোন এক কোণেই লুকোনো রয়েছে অপার্থিব সৌন্দর্য, যোগ করেন হেলি।

বড়পর্দায় প্রতিকৃতি
শিল্পকলায় যখনই প্রেরণা কিংবা দৃশ্যকল্পের প্রয়োজন পড়েছে; তখন প্যারিসকেই প্রথমে বেছে নিয়েছেন শিল্পস্রষ্টারা। ‘ফ্রেঞ্চ কিস’, ‘এমেলি’ এবং ‘মিডনাইট ইন প্যারিস’র মতো অনেক ছায়াছবিই বছরের পর বছর ধরে আমাদের মানসপটে ফ্রান্সের রাজধানী সম্পর্কে এমনই সুনির্দিষ্ট আশাব্যঞ্জক একটি সুদৃঢ় ধারণাই গড়ে তুলেছে; যা খুব সহজেই মুছে ফেলাও সম্ভব নয়।
হলিউড আমাদের মনে এমন একটি ধারণা গেঁথে দিয়েছে যে প্যারিসে শহরময় ছড়ানো চটকদার সব হোটেল ও সেইন নদীর তীরঘেঁষা ছিমছাম ও পরিচ্ছন্ন বাঁধানো রাস্তায় দিনভরই দেখা মেলে নানা বর্ণের মানুষের কলরব।
এ প্রসঙ্গে ফরাসি লেখক হেলি দ্য লোকালকে বলেন, হলিউডের পুরোনো সিনেমায় প্যারিসকে এমনভাবে তুলে ধরা হয়েছে যে শিল্প, ফ্যাশন ও মণিমুক্তোর আকর্ষণে বিশ্বের ফ্যাশন লীলাভূমি এই শহরটির প্রাণকেন্দ্রে হাসিমুখে ঘুরে বেড়াচ্ছে একজন আমেরিকান।
এমনকি দ্য ডেভিল ওয়ারস প্রাদা’র মতো প্যারিসে চিত্রায়িত হলিউডের হালের ছবিগুলোতেও শহরটিতে গ্ল্যামার ও সৌন্দর্যই দ্রুতলয়ে আবর্তিত হচ্ছে বলে দেখানো হয়েছে। অথচ সিনেমাটির কাহিনির শুরু যেখানে সেই নিউ ইয়র্ক শহরের শশব্যস্ত বিপরীত চিত্রই ফুটিয়ে তোলা হয়েছে।

খাদ্যসম্ভার
সুস্বাদু হরেক পদের খাবার-দাবার ও নানা বর্ণ-গন্ধের পানীয় পানের বন্দোবস্ত ছাড়া কি কোনো রোমান্টিক অনুষ্ঠানের আয়োজন সম্ভব? এজন্যই শহরময় ছড়ানো-ছিটানো ৪০,০০০ রেস্তোরাঁ ও পান ভোজনসংক্রান্ত উত্তম ইতিহাসের জন্য প্রসিদ্ধ প্যারিসই রোমাঞ্চ-অন্বেষীদের প্রথম ও শেষ পছন্দ।
এ সম্পর্কে রোমান্টিক এই নগরীর একটি ট্যুর কোম্পানি এক্সপেরিয়েন্স প্যারিস এর কর্ণধার ল্যারি ডেভিস বলেন, ভোজনরসিক ব্রিটিশরা মূলত নানা পদের খাদ্যসম্ভার এবং ওয়াইন ও শ্যাম্পেনের মোহেই প্যারিসে ছুটে আসে।
রোমান্টিক স্থাপত্যের পটভূমিতে নির্মিত ঐতিহ্যগতভাবে মার্জিত বা আরামদায়ক কোন এক রেস্টুরেন্টে একান্তে দুজনের ডিনার সারার ভাবনা থেকেও বেড়ানোর জন্য অনেক জুটিরই প্রথম পছন্দের শহর প্যারিস।
সর্বোপরি, ভাসমান কোন রেস্তোরাঁয় নদীর বুকে ঘুরে বেড়ানোর ফাঁকে রাতের খাবারপর্ব সেরে নেয়ার এমন চমৎকার আয়োজন আপনি প্যারিস ছাড়া আর কোথায় পাবেন? যোগ করেন ডেভিস।

রোমান্টিক নগরবাসী
ফরাসি ব্লগার লিলি হেইজির ভাষ্য মতে, একটি শহরের আসল সৌন্দর্যই হলো এর বাসিন্দারা।
ফরাসিদের কাছে রাজধানীর ধ্রুপদি নাক-উঁচু বাসিন্দারা যদিও উপহাসের পাত্র; তবুও রোমান্টিক অভিজ্ঞতা প্রত্যাশীদের জন্য ‘প্যারিসিয়ানস’ বা প্যারিসবাসীই হতে পারেন আকর্ষণের মূল কেন্দ্রবিন্দু।
হেইজি বলেন, ফরাসি মাত্রই আবেগপ্রবণ, অত্যধিক কামুক ও ছলাকলায় পটু। তাদের সম্মোহিনীশক্তি ও ভাবাবেগকে অনুসরণ করতে ভয় না পাওয়ার সহজাত প্রবৃত্তিই আমি মনে করি এর চাবিকাঠি।
নান্দনিক ও কমনীয় এই শহরের সঙ্গে চিরায়ত ফরাসি আবেগ জুড়ে দিলেই আপনার হাতের মুঠোয় চলে আসবে একটি রম্যোপন্যাসের যাবতীয় মাল-মসলা।

২০১৩ সালে এক জরিপে বিশ্বের সেরা ‘সেক্সিয়েস্ট’ শহর নির্বাচিত হয় প্যারিস। এজন্য কেবল ফরাসিদের মনোহর ব্যক্তিত্বই নয়; তাদের ভাষারও রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা।
সার্চজায়ান্ট গুগলের অনুবাদ জরিপে উঠে এসেছে, ফরাসি ভাষায় শীর্ষস্থানীয় এক হাজার অনুবাদককর্মের মধ্যে ৩৪টিই প্রেমসম্পর্কিত। এটি অনুবাদ প্রকল্পের সবচেয়ে জনপ্রিয় অন্য পাঁচ ভাষার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি।
প্রকৃতপক্ষে Je t’aimeÍ এই ফরাসি বাক্যাংশটিই সর্বাধিক অনুবাদের অনুরোধ করা হয়েছিল। বাংলায় এই বাক্যাংশের অর্থ, ‘আমি তোমায় ভালোবাসি’। অবশ্যই চূড়ান্ত নয়, তবুও বলা যায়, ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসকে রোমান্টিক সৌরভে ভরপুর করে তোলার ক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে নিরবে অবদান রেখে চলেছে ফরাসি ভাষাও।

ইতিহাস-ঐতিহ্য
ঐতিহাসিকভাবেই, পশ্চিমা দুনিয়ায় মতবাদ, শিল্পকলা, কবিতা এবং বিপ্লবী রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র তথা সাংস্কৃতিক রাজধানীও ফ্রান্সের রাজধানী প্যারিসই। এছাড়া সেইন নদীর বাম তীরবর্তী শহরের ‘বুদ্ধিজীবী কোয়ার্টার’ প্রেমিকযুগলের কাছে পেয়েছে রোমান্টিক স্বর্গের স্বীকৃতি।
রোমান্টিকঘরানার লেখক এফ স্কট ফিট্জগেরাল্ড ও অ্যার্নেস্ট হ্যামিংওয়ে ১৯ শতক থেকে জ্যাজ যুগ বা ২০ শতক পর্যন্ত প্যারিসের জনসমাগম ও জীবনযাত্রা তাদের লেখায় তুলে এনেছেনে। ‘সিটি অফ লাইট’ এর জনজীবনের আদ্যোপান্ত পাঠকের সামনে প্রেমপূর্ণভাবে উপস্থাপন করেছেন দুজনেই।
অ্যা মুভ্যাবল ফিস্ট স্মৃতিকথায় গভীরতর ও রোমান্টিক অভিজ্ঞতার ভাঁড়ারে জমানো কথামালায় প্যারিসের ছবি এঁকেছেন হেমিংওয়ে। এটি বিশ্বের বিভিন্ন স্থানের মানুষজনের (যদিও তারা কখনোই প্যারিসে ছিলেন না) শহরটির প্রেমে হাবুডুবু খাওয়ার বিষয়টি ব্যাখ্যা করতে আমাদের খানিকটা সামনে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে!

নগরীর বাসিন্দারা কি প্রতারক?
লিলি হেইজি বলেন, প্যারিসে বসবাসের ক্ষেত্রে পুরোপুরি প্রত্যাশা পূরণ হয়। তবে হতাশার কথাও জানিয়েছেন এই নগরীর পাণিপ্রার্থী অনেকেই। বহুলালোচিত প্যারিস সিনড্রোম ঘোরাক্রান্ত জাপানি এক পর্যটক এমনই একজন, প্যারিসে আসার পর স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় যিনি মুষড়ে পড়েন। তিনি একের পর এক আবিষ্কার করেন অন্য আধুনিক কোন শহরের মতো সিটি অব লাইটের বিদ্যমান সবই ‘ফাঁদ’! যানজট, চিৎকার-চেঁচামেচি, পকেটমার, চড়া দাম, জঞ্জাল, মলিন ও জরাজীর্ণ গণপরিবহন তো বটেই; এমনকি ফুটপাতে কুকুরের বিষ্ঠাও তার চোখে পড়ে।
জোরদার নিরাপত্তা নিশ্চিত রাখতে সশস্ত্র নিরাপত্তাকর্মীরা দিনভর নগরীর পথে পথে ঘুরে বেড়ায়; চলে ব্যাগপত্র তল্লাশিও। এমন পরিস্থিতিতে সেইনের তীরঘেঁষা রাস্তায় দলবেঁধে বা একাকি হাঁটাচলা বা বেড়ানোর রোমান্টিক সেই পরিবেশ এখন আর নেই বলা চলে!
প্যারিসের বাসিন্দাদের বেশিরভাগ স্পষ্টতই এখন একাকি বাস করেন। রোমান্সের জন্য সুবিদিত, শহরটির বিদ্রুপাত্মক এমন হাল নগরবাসীর অনেকের জন্য অস্বস্তিকরও।
এছাড়া বিশ্বাসঘাতকতা ও বিবাহবিচ্ছেদের পরিসংখ্যান বিবেচনায়ও ফ্রান্সের রাজধানী, প্যারিসই সর্বার্গে! বর্তমানে শহরের বাসিন্দাদের ৪৩ শতাংশই সিঙ্গেল অর্থাৎ একাকি বাস করেন; যা দেশটির অন্যান্য অঞ্চলের চেয়ে ১০ শতাংশ বেশি। আর প্যারিসবাসীর মধ্যে যারা এখনও সম্পর্ক টিকিয়ে রেখেছেন তাদেরও ৪৬ শতাংশই অকপটে স্বীকার করেছেন সঙ্গী/সঙ্গীনীর সঙ্গে প্রতারণা করার কথা। দেশটির অন্যান্য অঞ্চলে এই হার ৪০ শতাংশ।
প্যারিসের বাসিন্দাদের বৈবাহিক জীবনও সুখের নয়। বর্তমানে শহরটিতে গত ২০ বছর ধরে সংসারধর্ম পালন করছেন এমন বিবাহিত দম্পতির হার মাত্র ২৫ শতাংশে নেমে গেছে। ৪১ শতাংশ জাতীয় গড়ের তুলনায় এ হার অনেক কম।
তবুও নিঃসন্দেহে বলা চলে, প্যারিসে এখনও আপনি চাইলেই কাটাতে পারেন নিজের মতো করে রোমান্টিক সময়। সুন্দর ঐতিহাসিক কোনো স্থাপনা বা ইতিহাসবিজড়িত স্থানে ঘুরে বেড়ানো অথবা ফরাসি কায়দায় রান্না করা বিশেষ কোন পদ ও অনন্য ওয়াইন সম্ভারও চেখে দেখতে পারেন। কিংবা অড্রে হেপবার্নের মতো ‘কামুক ফরাসি’ পরিবেষ্টিত হয়েও শহরজুড়ে চড়ে বেড়াতে পারেন রাজহাঁস! তবে স্থানীয়দের সঙ্গে ‘হৃদয়ঘটিত লেনাদেনার’ ব্যাপারে সাবধানতা অবলম্বন ছাড়া নেই অন্য কোন বিকল্পই; নতুবা পরিণতিতে কাঁদতে হতে পারে জীবনভর!
দ্য লোকাল অবলম্বনে ইমতিয়াজ মোহাইমেন