গোয়ানজোতে আবু ওয়াক্কাস রা. এর মাজারে

হাসিনা রশীদ

আমরা লঞ্চে নৌভ্রমণ করছি। লাইটের ঝলমলে আলোতে বিভিন্নভাবে তৈরি বিল্ডিংগুলো ঝিলমিল করছে, একটি মায়াময় পরিবেশ সৃষ্টি করেছে। আলো ঝলমল বাড়িগুলোর প্রতিচ্ছবি নদীতে পড়ে অপরূপ লাগছে, যেটা ভাষায় বর্ণনা করা কঠিন। আমি অপলক দৃষ্টিতে মন্ত্রমুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলাম। মনে হচ্ছে চোখ এদিক-ওদিক ফেরালেই বুঝি কোনটা বাদ পড়ে যাবে। মায়াবী স্বপ্নপুরিটি হারিয়ে যাবে। আমার স্বামী কবি মানুষ। লঞ্চ নদীর মাঝখান দিয়ে চলছে।  কবিকে সাথে নিয়ে লঞ্চের বারান্দার রেলিং ধরে দাঁড়িয়ে অপরূপ সৌন্দর্য অবলোকন করছিলাম।

গোয়াংজোর অন্যতম আকর্ষণীয় দর্শণীয়স্থান হচ্ছে সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. এর মাজার প্রাঙ্গন। আবু ওয়াক্কাস রা. ছিলেন নবী মোহাম্মদ স. এর মামা। তিনি সেনানায়ক হিসাবে ইতিহাসে প্রসিদ্ধ। সতের বছর বয়সে ইসলাম গ্রহন করেন। নবীজি স. এর দশজন সহচর যারা পৃথিবীতে থাকা অবস্থায় বেহেশত প্রাপ্তির সুসংবাদ পেয়েছিলেন, আবু ওয়াক্কাস রা. তাঁদের একজন। ভাবতে অবাক লাগে সেই সুদুর আরব থেকে ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে সেই সময়ে তিনি চীনের এই গোয়াংজোতে আসেন। চীন সফরে আমাদের অন্যতম প্রধান গন্তব্য এটি।

স্থানীয় বাংলাদেশি ব্যবসায়ি আতিককে সাথে নিয়ে আবু ওয়াক্কাস রা. মাজার জেয়ারত করার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম।

প্রায় ঘণ্টা দুই বাস জার্নি শেষে একখানে নেমে আরেক বাসে উঠলাম। আরো ঘণ্টা খানেরকেরও পরে মুল স্টপেজে বাস থামলো। কিছুদূর হাঁটার পর আবু ওয়াক্কাস রা. এর মাজার প্রাঙ্গন।

দরগা সংলগ্ন বড় গেটের সামনে অল্প কয়জন ভিখারী বসে আছে। তাদের দেয়ার জন্য কবি সাহেব কিছু চাইনিজ মুদ্রা আমার হাতে দিলেন। ভাগ করে দিলাম। গেটের ভেতরে একটু হাঁটার পরে বেশ সুন্দর বড় একটি মসজিদ রয়েছে। চারদিকে চওড়া সিড়ি ঘেরা। আসরের নামাজ পড়লাম মসজিদে। মেয়েদের নামাজের জন্য পার্টিশন দেয়া জায়গা রয়েছে। একপাশে টেবিলসহ ছোট বেঞ্চও আছে। বাচ্চাদের স্কুলের বেঞ্চের মতো, যারা বসে নামাজ পড়ে তাদের জন্য। একটি র‌্যাক রাখা আছে। তাতে বই, কোরআন শরীফ, জায়নামাজ, কিছু হেজাব ও কাপড় রাখা।

সংলগ্ন মসজিদটি পাহাড়ের বেশ উঁচুতে অবস্থিত। ঢালু পায়ে পীচের রাস্তা দিয়ে হাঁটতে লাগলাম। দুপাশ বিভিন্ন গাছগাছালিতে ভরা। কিছুদূর হাটার পর লোকজন দেখা গেলো। জিজ্ঞেস করে আরো কিছুদুর যাওয়ার পরে মাজারে ঢোকার একটি বড় কালো রং এর কাঠের দরজা দেখলাম। কিন্তু তালা বন্ধ। জিজ্ঞেস করে জানা গেল আছরের কিছু পরে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয়। এসময় জিয়ারত করতে দেয়া হয় না। সেদিন আর মাজারে যাওয়া হলো না।

পরেরদিন আবার এলাম।

টেকসিতে আমরা দু’জন মাজারের গেটে পৌঁছলাম। গেটের বাইরে রাস্তার দু’পাশে অনেক রকমের খাবারের দোকান। চটপটিঅলাদের মতো খোলা ভ্যানে দোকান সাজানো। আশপাশে বেশ কয়েকটি খাবারের রেস্টুরেন্ট রয়েছে। আবাসিক হোটেলও আছে। হরেকরকম বেচা বিক্রির পসরা। লোকজনে জমজমাট এলাকা।

কবি সাহেব বললের, প্রথম যেইবার এখানে আসি তখন এত লোক, এত বিশাল এলাকা, দোকানপাট, জাঁকজমক কিছুই ছিলো না। একটা ছোট্ট গেট ছিলো, অল্প ক’জন লোক ছিলো। একটু দূরে হেঁটে গেলে দুই/তিনটা রেস্টুরেন্ট ছিল।

আমি বললাম, সামনের দোকান থেকে কিছু কেনা যায় কিনা দেখি চলুন।

কিছু বিস্কুট কিনলাম নিজেদের জন্য। কিছু খেজুর নিলাম এখানে আগতদের উপহার দিতে।

গেট পেরিয়ে আমরা ভেতরে এলাম। এই গেট দিয়ে মানুষের যাতায়াতের ব্যবস্থা রয়েছে, গাড়ি যাওয়ার ব্যবস্থা নেই। প্রথমদিন যে গেট দিয়ে গাড়ি ঢুকার ব্যবস্থা আছে দেখেছি, সেখান দিয়ে সব গাড়ি যেতে দেয়না। দুপাশে গাড়ি পার্ক করার বেশ বড় জায়গা আছে। তবে এই গেটের পাশে সেই ব্যবস্থা তেমন নেই। ভেতরে যাওয়ার রাস্তা পাকা করা। দুপাশে ড্রেনের ব্যবস্থা আছে। রাস্তার দু’ পাশ বেশ উঁচু, ফল-ফুলের গাছ রয়েছে। পথটা উপর দিকে উঠে গেছে। পাহাড়ের উঁচুতে মাজার। এই রাস্তা ধরে অনেক দূর পর্যন্ত হেঁটে যেতে হয়।

মাজার প্রাঙ্গনে বড় কালো রং এর কাঠের দরজা খোলা। ভেতরে ঢুকার পথে বসার জায়গা আছে। সিমেন্টের চেয়ার-টেবিল-বেঞ্চ পাতা। জায়গাটা প্রশস্ত। মেয়েদের নামাজের জন্য পৃথক ঘর আছে। বেশ বড়। অজু করার স্থান, বাথরুম সবই আছে সিমেন্টের চেয়ার টেবিলের কাছাকাছি। একটি টিউবওয়েল আছে। এটা না-কি আবু ওয়াক্কাস রা. এর সময়কালে তৈরি। আগতরা টিউবওয়েলের পানি পান করে এবং নিয়ে যায় বরকতের জন্য।

কবি সাহেব জানালেন, মেয়েদের নামাজের ঘরটাই আগে মসজিদ ছিল। ভেতরের চম্পা গাছ অনেকদিনের পুরানো। বললেন, গাছটা কত বড় দেখেছো!

জুতা খুলে কালো দরজা দিয়ে ভেতরে এলাম। সিমেন্টের সরু রাস্তার দুপাশে ফুলের বাগান। সোজা হেটে গেলে একটি ঘরের ভেতরে বিখ্যাত সাহাবি সা’দ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. এর মাজার। সালাম দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। একটা ভাল লাগার অনুভূতি অন্তরে ছড়িয়ে পড়লো। আমার স্বামী কবরের পাশে গিয়ে বসলেন। আমি খানিক দূরে এক কোনায় চলে এলাম। কবরের ওপর গিলাব দেয়া। আশপাশে কয়েকটি ছোট্ট র‌্যাক-এ কোরআন শরীফ ও বিভিন্ন বই রাখা আছে। একটা ছোট্ট টেবিলও আছে।

আমরা জেয়ারত শেষে বেরিয়ে এলাম। বাইরে সিমেন্টের চেয়ারে বসলাম। বললাম, খেজুরগুলো দেই সবাইকে।

উনি বললেন, সেগুলো বের করে সিমেন্টের টেবিলে রাখো।

ইন্দোনেশিয়ান ও মালয়েশিয়ান মেয়েরা দল ধরে এলো। ওরা চীনে পড়াশোনা করতে এসেছে। সবাইকে খেজুর দিলাম। ওরা আমাকে নিয়ে ছবি তুলতে চাইলো।

খিদে লেগেছে। কবি বললেন, মাজারের বাইরে একটু হেঁটে গেলেই অনেক রেস্টুরেন্ট পাবো। চলো ওখান থেকে কিছু খেয়ে নেবো।

কিছুদূর হাটার পরে হালাল লেখা বেশ কিছু রেস্টুরেন্ট দেখলাম। হালাল লেখা দেখে রেস্টুরেন্ট-এ ঢুকলাম। চীনে খাবারের বিষয়ে একটু সতর্ক থাকা ভালো। মেনু দেখে বললেন, কি খাবে?

আপনিই অর্ডার দিন। আমার একটা কিছু খেলেই হবে।

কয়েকপদ খাবারের অর্ডার দেয়া হলো। খাবার এলো। খেতে ভালো লাগলো না, সামান্য খেলাম। খেয়ে মাজার প্রাঙ্গনে ফিরে এলাম। এসে দেখি এক পাকিস্তানি লোকজনকে খাবার দিচ্ছে। ওয়ান টাইম প্লেটে বুটের ডাল দুটো ডিম ও দুটো করে পরোটা। আমাদের দু’জনকেও দুটো প্লেট দিলো।

উনি বললেন, খেয়ে এসেছি। এখন  দুটো পরোটা ডিম খেতে পারবো না।

যতটুকু পারবেন ততটুকু খেয়ে নিন। এটা তবারক। রেস্টুরেন্ট এর খাবার আমার ভালো লাগেনি, খেতে পারিনি। আমি খেতে পারবো।

খাবার খুব সুস্বাদু লাগলো। সবটুকুই খেয়ে নিলাম। কবি বললেন, হযরত আবু ওয়াক্কাস রা. এর তরফ থেকে মেহমানদারী করা হচ্ছে। মজাতো লাগবেই। এত মজা লাগছে, খাওয়া ছাড়তে পারছি না। তিনিও সবটুকু খেয়ে নিলেন।

আমরা প্রায় প্রতিদিন মাজারে যেতাম। একদিন মাজারে যেয়ে আমার খুব কলা খেতে ইচ্ছে করলো। কবিকে বললাম, আমার কলা খেতে ইচ্ছে করছে।

উনি জবাব দিলেন, এখানে মাজারের ভেতরে কলা কোথায় পাব? রাগত স্বরে বললেন, চলো জিয়ারত করি।

মনে মনে ভাবলাম কেন যে বলতে গেলাম! না বললেই হতো!

জিয়ারত করার পর মেয়েদের নামাজ ঘরে যেয়ে নামাজ শেষ করে দোয়া পড়ছি। এক মহিলা এলেন। নামাজ শেষ করে আমরা যে কজন মহিলা ছিলাম সবাইকে সাগর কলা খেতে দিলেন। কবি সাহেবের ডাইবিটিকস। কলা খাবেননা। তাই সেখানে বসেই আমি খেয়ে নিলাম। বেশ বড় কলা। খুব সুস্বাদু।

বাইরে এসে উনাকে বললাম, আপনার কাছে চাইলাম, কলাতো খাওয়াতে পারলেন না। কিন্তু এক মহিলার মাধ্যমে আমাদের জন্য কলা পাঠিয়ে মেহমানদারী করলেন আবু ওয়াক্কাস রা.। খেতেও খুব টেস্ট ছিলো। উনি বললেন, বেশ! খুব ভালো হলো ব্যাপারটা। চল দুপুরের খাবার খেয়ে আসি।

সাদ ইবনে আবু ওয়াক্কাস রা. এর দরগার ঠিকানা: 901, Jiefangbei Lu, Guangzhou, 510010 ChinmvÕ`a. Tel. +86 20 86692743, Metro Line 2 To Yuexiu Park.

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!