
‘দ্য ইউনাইটেড রিপাবলিক অফ গুলশান’ বা ‘সংযুক্ত গুলশান প্রজাতন্ত্র’ এমনই এক অদ্ভুত জায়গা যেখানে আজব সব মানুষের বসবাস। এটি একটি উত্তর-আধুনিকতাবাদী কাল্পনিক রাষ্ট্র বা সমাজ যেখানে নানারকম অবাক করা দুর্ভোগ কিংবা অবিচারের ছড়াছড়ি। এই ‘রাষ্ট্র’টি সংগঠিত হওয়ার ছয় দশক পরেও এখানে বসবাস করা মানুষগুলোর নিজস্ব কোনো গোষ্ঠি কিংবা কোনও আপন সম্প্রদায় বলে কিছু নেই, আসলে তারা একে অপরকে চেনেন না। তারা চুপচাপ কাজে চলে যান এবং কাজ শেষে নীরবে দাড়িয়ে থাকা সারিসারি অচেনা ফ্ল্যাটগুলোতে ফিরে আসেন। তাদের বাড়ির সাথে সংলগ্ন রাস্তাগুলো ধরে তারা চলাচল করেন এবং এগুলোরও একটি ভিন্নরকম বৈশিষ্ট রয়েছে, এসব বাড়ির ভেতরে বিদেশী পোষা প্রাণী-পাখিরও দেখা মেলে। এখানে বাবা-মায়েরা সন্তানদের ছাড়াই একাএকা জীবনযাপন করেন, কারণ তাদের সন্তানরা কানাডা নামক দূরের কোনও এক শীতল দেশে বসবাস করছেন।
এখানে মেয়েদের সাথে প্রেম করার জন্য কোনও ছেলেকে খুজে পাওয়া যায়না, এখানে কোনও স্কুল বা কলেজ নেই, আছে কেবল কোচিং সেন্টার, যাদের একমাত্র কাজই হচ্ছে আপনাকে বিদেশে উড়ে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত করা। এখানে খেলার মাঠ মানে শুধু অসুস্থ্য বয়স্ক মানুষের হাঁটার জায়গা, এগুলো ছোট বাচ্চাদের ফুটবল খেলার জন্য নয়। এখানে বাইরে খাওয়া মানে নিজের অবস্থান প্রকাশের এক ধরণের প্রদর্শনী, লোক দেখানো অভিজ্ঞতা- খাবার উপভোগ করার আনন্দ এখানে নেই। এখানে প্রচুর টাকা খরচ করে নীরবতা কেনা হয়। এই রাজ্যের পুরো পরিবেশই বলে দেবে সফল হলে কেমন ভয়ঙ্কর ভবিষ্যৎ আপনার জন্য অপেক্ষা করছে।

বনানী এবং গুলশানের পাখির চোখে দৃশ্য, ঢাকা -১৯৬৬
একদা ‘ভোলা’ নামক সবুজ জলাভূমির গ্রামটি দেশের রাজধানী ঢাকার সবচেয়ে অভিজাত এলাকার স্বীকৃতি পাওয়ার ষাট বছর পরেও গুলশান প্রকৃত অর্থে এখনও কোনও কাঙ্খিত চরিত্র অর্জন করতে পরেনি; এটি এমনকি সুন্দর সমাজে বসবাসের জন্য সত্যিকার অর্থে একটি পাড়াও হয়ে উঠেনি। বরং এটিকে বলা যায় একটি বিশালাকার হোটেল যেখানে বিত্তশালী লোকজন থাকেন এবং বাড়ি থেকে মাত্র ৫০০ গজ দূরত্বে অফিসে যাওয়ার জন্য ভীষণ দামিদামি গাড়ি কেনেন। এটি আসলে একটি যাযাবরদের সম্প্রদায়, মিথ্যা এবং নকল হাসি যাদের জীবনের অনুষঙ্গ, এদের সাথে থাকে বধির একদল কাজের মানুষ এবং সতর্কভাবে চুপচাপ কাজ করে যাওয়া কিছু সহকারী দল।

১৯৭৭ সালের শীতকালে গুলশান থেকে বাড্ডা যাওয়ার পথ – ছবি-পিয়ের ক্যান্টিন
সত্যি বলতে গুলশান আমাদের সৃজনশীলতা ধ্বংসের জীবন্ত প্রতীক- প্রথমে এখানে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সচিব এবং রাজনীতিবিদরা এসেছিলেন, তারপরে একে একে কোটিপতিরা এসেছেন যাদের মধ্যে ব্যাংক লুটেরা থেকে শুরু করে পোশাকশিল্প মালিকরাও রয়েছেন, যারা হয়তো আপনার-আমার জন্মস্থানের গ্রাম বা শহরের কাছে কোনো নদী ধ্বংস করে এখানে এসে এখন ৬,০০০ বর্গফুটের সুইমিংপুল-সংযুক্ত কনডোমিনিয়ামে চুপচাপ বসবাস করছেন। গুলশানের আজাদ মসজিদে নামাজের সময় প্রথম কয়েকটি কাতারে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের তুলনায় বা অতীতের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি সংখ্যক ‘ডলার’-কোটিপতিদের আধিক্য দেখা যাবে। এটা সত্যিই অদ্ভুত যে আমরা গুলিস্তানকে আমাদের জীবনের অংশ করে ফেলেছি, কিন্তু গুলশানকে নয়।



গুলশান আজাদ মসজিদ
আমরা ‘ভোলা বা গুলশান-গ্রাম’ থেকে আজকের মেগা গুলশান রূপান্তরের প্রত্যক্ষদর্শী- যেখানে আমার বাবা ১৯৬৬ সালে মাত্র ষাট হাজার টাকারও কম খরচে এল-নূর ভিলা তৈরি করেছিলেন গুলশানের ৩৫ নম্বর রোডে, যে বাড়ির নম্বর সিডব্লিউএনসি-৩৭।
গঠিত হওয়ার ষাট বছর পরে আজও ‘দ্য ইউনাইটেড রিপাবলিক অফ গুলশান’ আসলেই একটি অদ্ভুত জায়গা, এক আজব ভাবনার জগৎ!! (ঢাকা ডায়েরি থেকে)