‘পালমারেস’ এর মুসলিম রাজা

আব্দুল হাই ফারূকী

দক্ষিণ আমেরিকার বিশাল দেশ ব্রাজিল। ফুটবলের জন্য দুনিয়াবাসির কাছে অন্যতম জনপ্রিয় রাষ্ট্র এটি। এই দেশেরই একজন জাতীয় বীর হলেন ‘জুম্বি’। তিনি কিং ‘জুম্বি’ বা রাজা ‘জুম্বি’ নামে বিখ্যাত। সবচেয়ে আশ্চর্যের বিষয় হচ্ছে সূদুর দক্ষিণ আমেরিকার  দেশ ব্রাজিলের এই রাজা ছিলেন একজন মুসলিম। ইসলামের হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের এই মহানায়ক সপ্তদশ শতাব্দীতে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রামের নের্তৃত্ব দিয়েছিলেন।

কিভাবে ইসলাম সপ্তদশ শতাব্দীতে ব্রাজিলে পৌঁছুলো? আর কিভাবেই বা একজন মুসলিম সেখানে রাজা হতে পারে? এর উত্তর পাওয়া যাবে চায়ের চিনির ভেতর।

বর্তমান সময়ের মত প্রাচীনকালে ঘরে ঘরে চিনি পাওয়া যেতোনা। কথাটি এশিয়া বা মধ্যপ্রাচ্যের ক্ষেত্রে ততোটা সত্য না হলেও ইউরোপের ক্ষেত্রে পুরোপুরি সত্য। ইউরোপকে এশিয়া থেকে চিনি আমদানি করতে হতো। কারণ আঁখ উৎপাদন হয় গরম আবহাওয়ায়। ফলে দামী জিনিস হওয়ায় চিনি শুধু অভিজাত শ্রেণীরই সামর্থের মধ্যে ছিল। সাধারণ মানুষেরা কোন উৎসব ছাড়া চিনির মুখ দেখতোনা।

পঞ্চদশ শতাব্দীর শেষভাগে কলম্বাস আমেরিকা মহাদেশে তার দ্বিতীয়বার অভিযানের সময় এশিয়ার কিছু আঁখ বয়ে নিয়ে যায়। সেগুলো বপন করার পর দেখা যায় এশিয়া-আফ্রিকার চেয়েও দক্ষিণ আমেরিকায় আঁখ ভালো উৎপাদন হয় এবং এর ব্যবসাও খুবই সম্ভাবনাময়। ইউরোপের সাধারণ মানুষ প্রথমবারের মত চিনি/মিষ্টি হাতের নাগালে পায়। আমেরিকায় চিনির ব্যবসা বাড়তে থাকে। এক পর্যায়ে এটি সবচেয়ে লাভজনক ব্যবসার  পরিণত হয়। ইউরোপের চাহিদা মেটাতে তখন আঁখের ক্ষেতে আরও মজুরের দরকার পড়ে যায়। স্থানীয়রা কাজে অস্বীকৃতি জানালে ইউরোপীয় কলোনিস্টরা মধ্য আফ্রিকা বিশেষত কঙ্গো ও এঙ্গোলা থেকে হাজার হাজার মানুষকে বন্দী করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয় দাস হিসেবে আঁখ ক্ষেতগুলোতে বাধ্যতামূলক শ্রম দেয়ার জন্য। শুরু হয় আফ্রিকার নিগ্রোদের অন্ধকার দিন। শুধু ব্রাজিলেই ৩০ লাখ মানুষকে দাস হিসেবে নিয়ে আসা হয়।

মধ্য আফ্রিকার জনসংখ্যার একটি অংশ ছিলো মুসলিম। কঙ্গোর এক মুসলিম রাজাকে পরাজিত করে পর্তুগীজরা রাজকন্যাকে তার শিশুপুত্র ও সমগ্র রাজবংশসহ দাস হিসেবে ব্রাজিলে বিক্রি করে দেয়। মুসলিমরা সবসময় ছিলেন স্বাধীনচেতা। তারা ইউরোপীয়দের দাস হিসেবে বেঁচে থাকতে চাইলেননা। অধিকাংশ ক্ষেত্রে তাদের জাহাজ থেকে ভূমিতে নামানোর সাথে সাথে তারা পালাবার চেষ্টা করতেন। আবার অমানুষিক পরিশ্রম ও নির্দয় নির্যাতন থেকে রক্ষা পেতে অনেকে পালিয়ে যেতেন গভীর জঙ্গল বা দুর্গম এলাকায়।

সপ্তদশ শতাব্দীর একেবারে শুরুর দিকে অনেক দাস ব্রাজিলের ‘পালমারেস’ নামক এক দুর্গম এলাকায় গিয়ে একটি মুক্ত দাসদের কমিউনিটি গড়ে তোলেন যা ইউরোপীয়দের থাবা থেকে ছিল মুক্ত। এই মুক্ত ভূমির কথা শুনে আরও অনেক দাস পালিয়ে এসে সেখানে বসতি গড়েন। দেখতে দেখতে এর জনসংখ্যা ৩০ হাজার ছাড়িয়ে যায়। এই মুক্তভূমির রাজা হন কঙ্গোর সেই মুসলিম রাজকুমারীর সন্তান ‘গাঙ্গা জুম্বা’।

‘গাঙ্গা জুম্বা’র পর রাজা হন তার বোন সাবিনার ছেলে ‘জুম্বি’। জুম্বি তার তারুণ্য থেকেই শক্তিশালী শারীরিক গড়ন ও চতুর সামরিক স্ট্র্যাটেজির জন্য বিখ্যাত ছিলেন। এর মধ্যে বেশ কয়েকবার পর্তুগীজরা পালমারেস আক্রমণ করলেও জুম্বির প্রতিরোধে পিছু হটে তারা। বিভিন্ন যুদ্ধে তার অসম সাহসিকতা তাকে খ্যাতি এনে দেয়।

জুম্বি রাজা হবার ১৫ বছর পর ১৬৯৪ সালে পর্তুগীজরা বড় আকারে হামলা চালায়। পর্তুগীজদের তৎকালীন আধুনিক আর্টিলারি ফায়ারের সামনে পালমারেস আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারেনি। পালমারেস দখল হয়ে যায়। জুম্বি প্রাণে বেঁচে গেলেও পায়ে আঘাত পান। তিনি আরও দেড় বছর পর্তুগীজদের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ চালিয়ে যান। কিন্তু তারই এক সাবেক প্রজা বিশ্বাসঘাতকতা করে তার আস্তানার খবর পর্তুগীজদের দিয়ে দেয়। ২০ নভেম্বর, ১৬৯৫ সালে গ্রেফতার করা হয় রাজা জুম্বিকে। সেখানেই শিরোচ্ছেদ করা হয় তার। রাজা জুম্বির জীবনী নিয়ে ব্রাজিলে একাধিক চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে। সেই সাথে তার সম্মানে ব্রাজিলের মেসিও শহরের ‘জুম্বি দোস পালমারেস ইন্টারন্যাশনাল এয়ারপোর্ট’ এর নামকরণ করা হয়েছে।

(সূত্র: বিদেশি জার্নাল অবলম্বনে)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!