‘বেহেশতি চকলেট’..

গোশত কিনবো। গরুর গোশত। তেহাড়ি সাইজ কাটিং হবে। সাধারণ বাজার থেকে গোশত কেনা ঝুকিপূর্ণ। মাংস ব্যবসায়িদের একটা বড় অংশ দুষ্টু। কিছু বাজারের দোকানি অতিরিক্ত দুষ্টু। ডাকাডাকি করে তারা কাস্টমার ডাকবে। বাজারের সেরা গোশত দেখাবে। ওজনে এক দুই পিস বেশি দেবে। কিন্তু বাসায় আনার পরে দেখা যাবে গোশতের মধ্যে পর্দা, চর্বি এবং হাড়যুক্ত দুর্বল কোয়ালিটির মাংস। বোনাস বিপদ হিসাবে ওজনও কম হবে।

গরুর গোশত ৭৫০ টাকা কেজি। এক কেজি গোশতের স্টান্ডার্ড টুকরা হয় ১৬ থেকে ১৮ পিস। অর্থাৎ প্রতি টুকরা গোশতের দাম প্রায় সাতচল্লিশ টাকা। হাড্ডি-চর্বি-পর্দা বা ওজন কমের জন্য যদি ৫ টুকরা গোশত কম হয়, তাহলেও নেট লস ২৩৫ টাকা। অর্থাৎ ৭৫০ টাকার সদাই কিনে ২৩৫ টাকা টাকা ধরা খাওয়া। তবে এখানে টাকা বড় কথা না। কেউ ছল্লিবল্লি করে ঠকিয়ে পাঁচ টাকা নিলেও জ্বালা হয়। আবার ফকিরকে পাচশ টাকা দান করে দিলেও মন ভালো লাগে। মানে প্রতারিত হয়ে কাউকে এক কাচ্চা ছাড় দিতেও আত্মা জ্বলে যায়। কিন্তু ভালোবাসার মাধ্যমে পুরো পৃথিবী দিতেও কোনও আপত্তি থাকেনা, বিষয়টা সেরকম।

গোশতঅলাদের দুষ্টামি থেকে বাচার একটি উপায় আছে। এলাকার দোকান থেকে গোশত কেনা। তাতে ঝুকি কম থাকে।

কাটাবন ঢালে একটা নতুন দোকান হয়েছে। সেখানে এসেছি। দোকানীর নাম মনোয়ার। এলাকার ভেতর সাধারণত দিনেদিনেই মাংস বিক্রি হয়ে যায়। এখন সন্ধ্যা বাজে সোয়া সাতটা। বেলা শেষ, রাতের শুরু। দোকানে এখনো যথেষ্ট পরিমাণ মাংস আছে। জিজ্ঞেস করলাম, দাম কত?

মনোয়ার নন বেঙ্গুলি। হিন্দি-উর্দু মিক্সড বাংলায় বললো, আপনের কাছ থিকা কি বেছি (বেশি) রাখুম? আমার এইখান থিকা গোশত যে একবার খায়, ছে (সে) আবার আছে (আসে)। জিনিছ ছলিড। দাম ছলিড। সে দাম বললো।

আমাকে দুই কেজি গরু দেবেন। তেহাড়ি কাটিং করে দিবেন। ‘কোরোলি’ এবং ‘ডকরের’ মাংস থেকে মিলিয়ে দিবেন। চর্বি-হাড্ডি দিবেন না। (গরুর রানের এবং বুকের বিশেষ অংশকে ‘কোরোলি’ এবং ‘ডকর’ বলা হয়। এটি খেতে সুস্বাদু)।

আগের দিন নিছিলেন, খারাপ ছিলো?

খারাপ ছিলোনা। তবুও বলে দিলাম। আপনারাতো এক দুইবার ভালো দেন, তারপরে গোল দেওয়া শুরু করেন। মেসি রোনালডোও আপনাদের কাছে ফেইল!

মনোয়ার কসাই বললো, আমি তেহাড়ির গোশতটা আগে বানাই, আপনে দেখেন।

গোশত খারাপ দিয়েননা কিন্তু.. 

আজকে ছকালেও সত্তুর নম্বর বাড়িতে ২৯টা খাছি আর তিন গরু দিছি, বিয়ার অনুষ্ঠানের জন্য। খারাপ হইলে নিতো?

একটি মুদি দোকানের শেষপ্রান্তে মনোয়ার কসাইয়ের গোশতের ‘সাবলেট দোকান’। সেই দোকানও  মাল্টি কালার।  সামনে পাইপের র‌্যাক। লোহার পায়া। লাল রঙ করা। তাক আছে তিনটা। গোশত ঝুলছে। সামনে টেবিলের মতো পাটাতন। খানিকটা অংশ রাস্তায় ইট দিয়ে সেটিং করা। উপরটা লাল ওয়ালক্লথ দিয়ে ঢাকা। এক অংশে দুইভাজ করে ছালা বিছানো। ছালার উপর গাছের গুড়ি। পেশাদার কসাইরা এটাকে বলে ‘খাইট্টা’। এটির উপর গোশত কাটা হয়। ডানপাশে ওজন মাপার ডিজিটাল মেশিন। মেশিনের ওপর স্টীলের গামলা আছে। স্ক্রীনে দেখা যাচ্ছে ৪৮ গ্রাম। তার পাশে আরেকটি পাত্র। ওয়ালক্লথের ওপর নানা পদের বাতিল গোশত, চর্বি, পর্দা, হাড্ডি ইত্যাদি রাখা।

র‌্যাকে গরুর টুকরা করা রান ঝুলছে। পাশে বড় আরো দুটি খন্ড। তারপাশে খাসির সামনের পা ঝুলানো।

মনোয়ার কসাই গরুর রানের ভেতর থেকে ‘কোরোলির গোশত’ বের করছে। খুব সুন্দর করে মাংস কাটছে। পর্দা ফেলে দিচ্ছে। চর্বি ছাড়িয়ে নিচ্ছে। বড় হাড্ডি-দুই একপিস দিতে গেলেই আমি বাধা দিচ্ছি। সে বাদ দিচ্ছে। কাটা মাংস বোলের উপর রাখছে।

আরেকটা গোশতের খন্ড থেকে ‘ডকরের’ মাংস বের করে কাটলো। তারমধ্যে কিছু হাড়ও সে পিস করছে, দেখতে গোশতের মতো। আমি ঈগল পাখির চোখে তাকিয়ে ছিলাম। বললাম, এসব কী করেন? আবার হাড্ডি দিচ্ছেন?

এইটা হাড্ডি না স্যার..।

না-না আমাকে হাড্ডি দেওয়া যাবেনা।

কুইলামতো স্যার এইটা ছেই হাড্ডি না। এইটা একবার খাইলে আবার খাইতে চাইবেন। বলেই সে তেহারি সাইজের কাঁচা হাড্ডির টুকরা মুখে দিলো। চকোলেটের মতো করে গালের ভেতর ঘুরাচ্ছে। সামনের দুই দাতে কামড়াচ্ছে।

আমি বললাম, করেন কী, কাঁচা হাড্ডি খাচ্ছেন?

এই হাড্ডি কাঁচা খাইতেই এমুন ছাদ (স্বাদ) তাইলে পাঁক (রান্না) করলে কেমন টেস্ট হইবো আপনেরে বুঝানের জন্য খাইতাছি। এই হাড্ডি একবার খাইলে বেহেশতে গিয়াও এই হাড্ডি খাইতে মন চাইবো।

মনোয়ার কসাই বেহেশতি হাড্ডি চিবুতেচিবুতে গোশত কাটছে। ফাঁকেফাঁকে চোড়া দৃষ্টিতে চোখের পাতা উল্টে আমার দিকে তাকাচ্ছে। তার গালের ভেতর নড়াচড়া চলছে। যেকোনো মুহূর্তে সে কাচা হাড্ডি মুখ থেকে বের করার উছিলায় সামনের দিকে থুতু মারতে পারে। মারলে আমার গায়ে এসে পড়ার আশংকা আছে। থুতুর ভয়ে একটু পাশে সরে এলাম। গরুর হাড্ডিও যে ‘বেহেশতি চকলেট’ হতে পারে এটা নি:সন্দেহে নতুন জ্ঞান আমার জন্য।

মনোয়ার কসাইয়ের কান্ড দেখছি। তার চুলদাড়ি ফোর কালার। মাথার চুল কচকচা কালো। গোঁফ-দাড়ি, মেহেদি লাল, সাদা এবং ধূসরকালো মিক্সড। স্বাস্থ্য ভালো। পরনে গেনজি। টাইট ফিটিং। ভূরি আছে। সে গোশত বানাচ্ছে।

এরমধ্যে দুই একজন লোক এসে গরুর গোশত নেড়েচেড়ে যাচ্ছে। টুকটাক প্রশ্ন করছে। একজন জিজ্ঞেস করলো, আজকে গোশত এখনও শেষ হয় নাই ক্যান? গোশত ভালো না না-কি? কেজি কত?

আরেকজন বললো, এটাতো মনে হয় বুড়া নাহলে অসুখঅলা গরু। গোশত এতো শুটা ক্যান? এগুলার দাম কম হওয়া উচিত। কত করে?

মনোয়ার কোনো জবাব দিলোনা। মাংস খানিক্ষণ খোচাখোচি করে তারা চলে গেলো। যাওয়ার পরে নিজে থেকেই বললো, এরা এক দুই মাছে (মাসে) হয়তো হাফ কেজি গোশত কিনে। কিন্তু রোজ আইসা দিগদারি করে। গোশত ধইরা খুটাখুটি করে। ঘেরান (ঘ্রাণ) ছুকে..!

গরুর গোশতের এত দাম কিভাবে মানুষ কেজিকেজি গরুর গোশত কিনবে? ঘ্রাণ শুখে দেখলে অন্তত দুধের স্বাদ ঘোলে মেটে হয়তো।

মৃদু বাতাস বইছে। কিছু ধুলা উড়ছে। এরমধ্যে এক মহিলা ক্রেতা এলেন। পরনে নীল কামিজ। লাল প্লাজো। হাতে প্লাস্টিকের ব্যাগ। কপালে লাল টিপ। মাঝবয়স। আয়েশ করে বাজার করতে এসেছেন। দোকানের কাছে এসে জিজ্ঞেস করলেন, গরুর গোশত কত করে কেজি?

মনোয়ার কসাই চনমন করে তাকালো। বললো, কয় কেজি লিবেন?

চার পাঁচ কেজি নেবো। আগে দাম বলেন।

দামতো সুবাই জানে, সে দাম বললো।

বেশি চাচ্ছেন কেন? আপনি দিপুকে চিনেন? তিনি একটি বাড়ির নম্বর উল্লেখ করে বললেন, দিপু থাকে ঐ বাড়ির সাততলায়। আমরা পাচতলায়। সম্পর্কে আমি দিপুর বোন। আমরা এখানকার বাড়িঅলা। ভাড়াটিয়া না। আমরা প্রচুর মাংস কিনি। দাম ঠিক করে বলেন।

আপনে যখন মহল্লার মানুছ ২০ টাকা কইরা কেজিতে কম দিয়েন।

২০ টাকা কমনা, বরাবর ৭০০ টাকা দিবো। পাঁচ কেজি গোশত নেবো। পারলে বলেন।

মনোয়ার কসাই আমার তেহারি কাটিং বন্ধ করে ধামাধাম ঝুলন্ত গোশতের খন্ড নামিয়ে পটাপট কাটা শুরু করলো। খানিকটা অবাক হলাম। মনেমনে ভাবছি আমার কাছে সে দাম বেশি নিচ্ছে। উনার কাছে কম। এটা তাকে বলবো।

মনোয়ার কসাই দ্রুত হাতে বড়বড় টুকরা করছে। বিরাট এক থোকা চর্বি টুকরা করার সময় আপা (ক্রেতা) কাতর গলায় বললেন, ঐটা দিয়েন না প্লিজ! ওটা চর্বি। ওটা বাদ দেন।

এইটা তাইলে কারে দিমু ম্যাডাম, গোশতর মধ্যেতো চর্বি থাকবেই। চর্বি ছাড়া গোশত হয়না। খায়া ভালো পাইবেননা।

তাও এত বড়টা দিয়েননা।

সে চর্বির অংশ ছোট করে কুশলীভঙ্গিতে মিক্সড করে দিলো। এরমধ্যে কথার ফাকে বেশকিছু বড় হাড়ও পিস করে মাংসের মধ্যে চালান দিয়ে দিয়েছে। আমি দেখেছি। আপা তাকিয়ে দেখছেন, কিন্তু খেয়াল করতে পারছেন বলে মনে হয়না। ‘তিনি দিপুর বোন’, সম্ভবত এই বোধ থেকে নিশ্চিন্ত আছেন।

মনোয়ার কসাই গোশত মাপনীতে তুলতে তুলতে বললো, আমার ফোন নম্বর নিয়া রাখেন, যেসুমকা গোশত লাগবো, খালি ফোন দিবেন। বাছায় (বাসায়) দিয়া আছবো। পয়ছা পরে দিবেন।

আপা খুশি মনে বললেন, প্রতিমাসে আমরা প্রচুর গোশত খাই, আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না। যদিও এত খাওয়া ঠিকনা। আসলে মাছ খাওয়া উচিত!

কে কইলো গোশত খাওয়া উচিত না?

গরুর গোশততো হার্টের জন্য খারাপ।

ভুল কথা ম্যাডাম। গোশত হইলো ছক্তি (শক্তি)। আল্লাহর দান। গরুর গোশত ঘি দিয়া পাক করতে হয়। ভেজাল সয়াবিন দিয়া পাক করলে হার্টের ব্যারাম, ডায়বেটিস এইসব হইবো না-তো কী?

আপা মনোয়ার কসাইয়ের সার্ভিসে বেশ সন্তুষ্ট। জিজ্ঞেস করলেন, আপনাপর বাড়ি কী বরিশাল?

উনার প্রশ্ন শুনে আমি অবাক হলাম। কোথায় বরিশালের ভাষা আর কোথায় ননবেঙ্গুলি ‘বাংলা’, আকাশ পাতাল তফাৎ। উনি মনোয়ারকে আবার বললেন, আমি ঠিকই ধরেছি, আপনার গ্রামের বাড়ি বরিশাল! আপনি বরিশালের লোক।

মনোয়ার বিব্রতভাবে বললো, আমগো দেছ (দেশ) এই দেছ। বাপদাদা আমরা এই দেছেরই মানুছ! মোহাম্মদপুরে থাকি। সে মাংস আপার ব্যাগে তুলে ধরে বললো, পাচকেজি গোশতে দুইকেজি লস খাওয়াইলেন আমারে। ছকালে হইলে এইখানে ওজন হইতো ছাত (৭) কেজি। ছারাদিনে গোছত টাইনা ওজন কইমা যায়। লস হইলো ম্যাডাম..।

আপা এবার বিজয়ের অনুভবে আহলাদিত হলেন। বললেন, আমরাতো জানি, কখন কিনতে হয়..!

এইফাকে মনোয়ার গোপনভঙ্গিতে তার মুখ থেকে কাচা হাড্ডির টুকরা বাহাতে বের করে ফেললো। আমার দিকে চোরা চোখে তাকালো। চোখে চোখ পড়ায় শরম পেলো।

আপা কিছু টাকা দিয়ে বললেন, এটা রাখেন। আমার আরো কেনাকাটা আছে, সেসব সেরে নিয়ে যাচ্ছি।

তিনি পাশের দোকানে গেলেন।

আমি মনোয়ারকে বললাম, উনাকে তো হাড্ডি চর্বি মিক্সড করে দিলেন। কাজটা কি ঠিক হলো?

না দিলে চলবো ক্যামনে? আপনে সামনে না থাকলে নিচ থেকে আরো কিছু মিশাই দিতাম। আপনার জইন্য শরমে দিতে পারি নাই। টাটায়া চাইয়াই রইছেন..!

বলে সে খুবই স্বাভাবিক ভঙ্গিতে আমার তেহারি কাটিং আবার শুরু করলো। দুই কেজি চেয়েছিলাম। বড় মাংসখন্ডের বিভিন্ন জায়গা থেকে ডকর এবং কোরোলির গোশত কেটে নিতে হচ্ছে। বহুকষ্টে সে এক কেজি সাতশ গ্রাম দিলো। বললো, আইজ এইটুকুই নেন। আপনারে দেওয়ার মতো ভালো মাংস নাই।

আপনারা এই যে গোশতে ভেজাল করেন, এটা খুব ডেনজারাস। এইটা ঠিকনা।

বাংলাদেছে ভেজাল কোন জাগায় নাই স্যার? মাথা থিকে আগা সবখানে ভেজাল, আপনি পরীক্ষা কইরা দেখেন আমার কথা। তয় আপনারে একটা বুদ্ধি শিখাই দেই, ভালো গোস্ত খাইতে চাইলে যেই কোনো কসাইয়ের দুয়ারে গিয়া কইবেন, তোমার ঈমানের উপর ছাড়লাম, ভালো গোশত দিও। ভেজাল কইরো না। তাইলে ভালো জিনিস পাইবেন। গোশত কিনতে গিয়া বেশি পাহারা দিবেন, দামাদামি করবেন তো লস খাইবেন। সত্য কই আপনের এইখানে তবু হালকাপাতলা ভেজাল আমি করছি, মিছা কথার কারবার আমরা করিনা। কিন্তু যদি ফোন কইরা দেন, নিজে না আছেন, সলিড গোশত বাসায় পৌছাই দিবো। কোনো ভেজাল থাকবোনা।

মনোয়ার কসাইয়ের এই কথার কোনো জবাব হয়না।

আমি চলে এলাম।

(পুনমুদ্রিত, ঈষৎ সম্পাদিত)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

error: Content is protected !!