প্যারিস নিয়ে পড়া আমার সেরা ভ্রমণের বই

প্যারিস নিয়ে পড়া আমার সেরা ভ্রমণের বই আবু সুফিয়ানের প্যারিসের পথে পথে..’

ড. সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম

আবু সুফিয়ানের নাট্যকার ও নাট্যপরিচালক পরিচিতিটি তার লেখক পরিচিতিকে প্রায় আড়াল করে ফেলেছে, অথচ এটি অনুচিৎ। আবু সুফিয়ান প্রথমত একজন ভাল লেখক, তারপর রম্যলেখক, তারপর নাট্যকার। নাট্যকার হিসেবে তার বয়স খুব বেশি নয়। স্ত্রী সাবৃনার সঙ্গে নাটকের পরিচালনাও তিনি যুগ যুগ ধরে করছেন না। এই যুগলের ধারাবাহিক নাটক খুব জনপ্রিয় হয়েছে। আবু সুফিয়ানের লেখা নাটকে হাস্যরস এবং কৌতুক থাকে, মানুষ যেগুলো দেখে আনন্দ পায়। আমি নিজেও তার নাটক পছন্দ করি। কিন্ত তাকে আমি সবসময় লেখক এবং রম্যলেখক হিসেবেই বেশি মূল্য দেই। তার নাটকের মান নি:সন্দেহে ভাল, কিন্ত নাটক দীর্ঘদিন টিকে থাকে না। আজ থেকে কুড়ি বছর পর কেউ মৌচাকে ঢিল নাটকটি নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করবেনা। অনেকের হয়তো মনেও থাকবেনা এই নাটকের কথা। কিন্ত তার বইগুলো নিয়ে উচ্ছাস প্রকাশ করতেই পারে কোনো পাঠক। আমি নিজেও ততদিন বেঁচে থাকলে তার ভোরের কাগজের আধঘন্টা নামের রম্য কলামের কথা তুলব, ওই লেখার প্রশংসা করব। এজন্য মাঝে মাঝে যখন আবু সুফিয়ান নাটক ছাড়া অন্য কিছু লিখতে বসেন, আমি আনন্দ পাই। আমার মনে হয় তিনি তার লেখক সত্তার কাছে ফিরে যাচ্ছেন, যেখান থেকে তার শুরু ।

বাংলাদেশে রম্যলেখকের বড়ই অভাব। রবীন্দ্রনাথের সেই ভদ্র বেশি, শান্ত বড় এবং বোতাম আঁটা জামার নিচে পোষ মানা বাঙালি সন্তান ভাল হাসতে জানেনা। হাসাতে জানাতো অনেক পরের কথা। অথচ একটি ভাষার চর্চিত রম্য প্রকাশ ওই ভাষার অন্তর্গত একটি শক্তিকে তুলে ধরে। খুব কম সংখ্যক বাঙালি লেখক এই শক্তির সন্ধান করেন। অনেকে আছেন, যারা রম্য লেখার চেষ্টা করেন কিন্তু মাথা দিয়ে হাসানোর পরিবর্তে মানুষকে সুড়সুড়ি দিয়ে হাসাতেই বেশি ভালবাসেন। ফলে হাস্যরসটি নির্মল এবং বুদ্ধিদীপ্ত হয় না। একটু ভাঁড়ামির দিকে চলে যায়। যারা ভাল রম্যলেখক তারা চর্চা করেন পরিশীলিত হাসির, বিমল রঙ্গের, মজার কৌতুকের। এদের একটা বড় গুণ, তারা অন্যদের নিয়ে হাসার আগে নিজেদের নিয়ে হাসেন। এজন্য তাদের অন্তরঙ্গভাবে গ্রহণ করে পাঠক। আবু সুফিয়ান সেই দলের লেখক।

আবু সুফিয়ানের লেখায় যে রস কৌতুক, তাতে প্রসন্নতার একটা ছোয়া আছে, তার ব্যাঙ্গ কৌতুকে পরিচ্ছন্ন রুচি এবং বুদ্ধির প্রকাশ ঘটে। মানুষকে তিনি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেন, তার চারদিকের জীবন, ঘটনাপ্রবাহ এবং দৃশ্যাবলীকেও তিনি  মনোযোগ দিয়ে দেখেন। তাদের ভেতরের ছোট ছোট বিপত্তি, অসঙ্গতি এগুলো বোঝার চেষ্টা করেন। এবং একসময় তিনি খুব সহজে জীবনের ছোট ছোট কৌতুকের প্রকাশগুলি চিহ্নিত করতে পারেন। তারপর এগুলোকে তুলে নিয়ে আসেন তার লেখায়, তার লেখা সময় নিয়ে, আনন্দ নিয়ে পড়তে হয়। এবং হাসতে হয়, হাসির ফাঁকে ফাঁকে ভাবনাকে তিনি উস্কে দেন।

আবু সুফিয়ান বেড়াতে ভালবাসেন এবং বেড়ানোর অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখতে ভালবাসেন। প্রতিবছর একবার তিনি ইউরোপ ভ্রমণে যান। সাথে থাকেন সাবৃনা। এই দুজনকে দেখে উইলস ফিল্টার সিগারেটের বিজ্ঞাপনের  কথাগুলো আমার মনে পড়ে, মেড ফর ইচ আদার। সাবৃনা কাজ ভালোবাসেন, আবু সুফিয়ানও কাজের আবসরে বেড়ানোটা তারা উপভোগ করেন। ফ্রান্সে ভ্রমণ নিয়ে আবু সুফিয়ান যে বইটি লিখেছিলেন, পড়ে খুবই আমোদ পেয়েছিলাম। ঢাউস আকৃতির সুটকেস নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যে কী বিড়ম্বনা, তা যারা জানেন, তারাই বলতে পারেন। কিন্ত এই যন্ত্রণার বিষয়টি অবলীলার বর্ণনা করেছেন আবু সুফিয়ান, এবং একটা দীর্ঘস্থায়ী হাসির বিষয়ে পরিণত করেছেন। প্যারিস ভ্রমণ সংক্রান্ত বইটি পড়লে কেউ প্যারিসের ইতিহাস ভুগোল বিষয়ে জ্ঞানী হতে পারবেন না, কিন্ত একটা প্রচ্ছন্ন কৌতুকের দৃষ্টিতে শহরটার দিকে তাকাতে গিয়ে তিনি এর একটি মানবিক দিক খুজে পাবেন। খুঁব সাধারণ কিছু মানুষের সঙ্গে পরিচিত হবেন, শেষ পর্যন্ত পাঠক প্যারিস ভ্রমণে আবু সুফিয়ান-সাবৃনার সঙ্গী হয়ে পড়বেন। প্যারিস নিয়ে লেখা আমার পড়া সেরা ভ্রমণের বই আবু সুফিয়ানের প্যারিসের পথে পথে।

লন্ডন নিয়ে তার এই বইটিতে গত বছরের ডিসেম্বরে তাদের আট-নয়দিনের লন্ডন সফরের যে বিবরণ আবু সুফিয়ান দিয়েছেন, তাতে লন্ডনের বড়বড় সব দর্শনীয় স্থাপনার জায়গা হয়নি, বরং সরল দুই পরিব্রাজকের দৃষ্টিতে ওই শহরের কিছু জায়গা এবং মানুষের বর্ণনা উঠে এসেছে। একটি হোটেলে তারা উঠেছেন, যার ভারতীয় এক কর্মচারী তাদেরকে সুন্দর একটি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করেছে। হোটেলের রেস্তোঁরায় নাস্তা করা, কেন লাঞ্চ ডিনার খাওয়া হবেনা তার বর্ণনা রয়েছে। একইসঙ্গে লন্ডনের খাবার দাবারের বয়ান, লন্ডনের ভূত, কেনাকাটা, লন্ডনের যাতায়াত নিয়ে তার অভিজ্ঞতা স্থান করে নিয়েছে কয়েক পৃষ্ঠা জুড়ে। খন্ডখন্ড এমন বর্ণনার মোজাইক দিয়েই লন্ডন শহরে ভ্রমণ কাহিনীর মোজাইকটি তিনি সাজিয়েছেন!

আবু সুফিয়ান কৌতুক করতে জানেন। অন্যকে, স্ত্রীকে এবং নিজেকে নিয়েও। বইটি পড়ার অভিজ্ঞতা, এই কৌতুকের কারণে খুবই সুখকর। আমি নিশ্চিত বইটি পাঠক প্রিয়তা পাবে।

আশা করি আবু সুফিয়ান ও সাবৃনা আরো দেশ ঘুরবেন। এবং আবু সুফিয়ান সেসব দেশ ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে লিখবেন। হাসাটা ভাল ব্যায়াম, এরকম কথা ডাক্তাররা বলেন। আবু সুফিয়ানের বই সেরকম নির্মল ব্যায়ামের ব্যবস্থা আমাদের করে দিয়েছে। সেজন্য তাকে ধন্যবাদ।

লেখক পরিচিতি: লেখক অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়  

(‘লন্ডন শহরেবইয়ের ভূমিকা, ফেব্রুয়ারি, ২০০৯)

Spread the love

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Translate »
error: Content is protected !!